খাস খবর বাংলাদেশঃ আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে দ্বাদশ নির্বাচনের প্রস্তুতির লক্ষ্যে দেশে অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি দলকে সাংগঠনিকভাবে পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করা, তৃণমূলের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব, রাগ-অভিমান সমাধান করার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকালের সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় সভাপতির বক্তব্যে এমন নির্দেশনা দেন দলের প্রধান শেখ হাসিনা। সকাল সাড়ে ১০টায় গণভবনে সভা শুরু হয়। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের প্রায় অর্ধশত নেতা উপস্থিত ছিলেন। সভার শুরুতে সূচনা বক্তব্য রাখেন দলীয় সভাপতি প্রধানমমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া এবং আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রস্তুতির বিষয়টি প্রাধান্য পায়। এছাড়া বৈঠকে তৃণমূলের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব, রাগ-অভিমান নিয়ে কথা হয়। নেতাকর্মীদের বিভিন্ন প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সভানেত্রী বলেন, আমার কানে অনেক খবর আসে। কে কি করেন সব কিছুই জানা আছে। তাই আগে নিজেদের মধ্যে রাগ-মান অভিমান সমাধান করার পাশাপাশি দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এমপিরা এমপিত্ব করবে, দলও করবে আবার খবরদারি করবে তা হবে না। দলের পদে থাকলেও বড় নেতা নয়, তার সাথে নেতাকর্মীও থাকতে হবে জানিয়ে বৈঠকে বলেন, ব্যক্তি চিন্তা না করে, আওয়ামী লীগের চিন্তা করতে হবে। আর নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে ষড়যন্¿ আরো বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন দলের প্রধান। বিদ্রোহী প্রার্থীদের একেবারে বহিষ্কার না করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতাই তা নিশ্চিত করেছেন।
সভায় শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক সচরাচর চার মাস বা দুই মাস পর করতাম। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে সেগুলো সময় মতো করতে পারেনি। এখন করোনা কিছুটা কমেছে। এছাড়া আমি গতবার জাতিসংঘের অধিবেশনে যেতে পারিনি। এবার যাচ্ছি। তাই মনে করলাম একটা সভা করি। প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্যের পরে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, ১৫ আগস্টের নিহতসহ আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতাদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। রীতি অনুযায়ী এরপর সভায় শোক প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়।
সভায় আট সাংগঠনিক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দলীয় নেত্রীর সামনে তাদের এলাকার জেলা-উপজেলা এবং ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যন্ত সাংগঠনিক অবস্থার ও রাজনৈতিক চিত্র কী তা জানিয়ে রিপোর্ট উত্থাপন করেন। সাত বিভাগের সাত সাংগঠনিক সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন দেশে না থাকায় তার পরিবর্তে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম সভায় ওই বিভাগের রিপোর্ট উপস্থাপন করেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের এই সাংগঠনিক রিপোর্টে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে তৃণমূলে এমপিদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দূরত্বের বিষয়টি উঠে আসে। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, অনেক এমপি নিয়মের বাইরে চলে যায়। নির্বাচনে জেতার জন্য অনেককে মনোনয়ন দেয়া হয়। তার অর্থ এই নয় যে, তারাও দলে খবরদারি করবে। এমপিরা যেন দলের ভেতরে দল তৈরি না করে- সে বিষয়ে সতর্ক করে তিনি বলেন, দল চলবে দলের গতিতে। দলের ভেতরে গ্রুপিং বা উপদল তৈরি করা যাবে না। ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। দলকে শক্তিশালী করতে হবে। ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতে হবে।
সভায় বিভিন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে আলোচনা হয়। এ সময় চিঠি দিয়ে ক্ষমা চাওয়ায় পাবনার একটি নির্বাচনে দলের প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করা ২০ জন নেতাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। এ বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা জানান, বিদ্রোহীদের নিয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। যারা অতীতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন বা দলের প্রার্থীদের বিপক্ষে কাজ করেছেন, তাদের দল থেকে একেবারে বহিষ্কার না করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেমন তাকে ভবিষ্যতে তাকে দলীয় মনোনয়ন না দেয়া বা দলের গুরুত্বপূরণ পদে না রাখা ইত্যাদি।
সভায় দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা বসে যেখানে যেখানে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল আছে তা দ্রুত নিরসনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সংগঠন যত শক্তিশালী হবে, দেশ যত এগিয়ে যাবে, ষড়যন্ত্র তত দানা বাঁধবে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে এই ষড়যন্ত্র আরো বাড়বে। এখনই দেশি-বিদেশি নানা সংস্থা মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণসহ দলীয় নেতাকর্মীদের দিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময় দলের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদকে এই বিষয়গুলো দেখভালের কথা বলেন।
মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিমুখী কোন্দলের বিষয়টিও নিয়ে আলোচনা হয়। ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, মাদারীপুরে কেন্দ্রীয় নেতা অনেক। এখানেই কোন্দল বেশি। নবগঠিত উপজেলা ডাসারে জেলা আওয়ামী লীগ একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে। এই কমিটিতে স্থানীয় এমপি ও দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহানের গোলাপের লোক না থাকায় গোলাপ সাহেব নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছেন। দলীয় কোন্দল নিরসনে দলীয় প্রধানের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এ সময় দলের প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ কোন কমিটি দেননি এ বিষয়টি দলীয় প্রধানকে জানিয়েছেন বলে সূত্র জানায়।
সভায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান অভিযোগ করে বলেন, আমি মাদারীপুর সদরের এমপি, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য অথচ সদরে দলের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। আমাকে দাওয়াত পর্যন্ত করা হয় না। এ সময় আগামী কয়েকদিনের মধ্যে মাদারীপুরে দলের একজন নেতার স্মরণসভায় নাছিমকে প্রধান অতিথি করার কার্ড দলীয় সভাপতিকে দেখান শাজাহান খান। একই সঙ্গে জেলা ছাত্রলীগ, যুবলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগসহ বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের অনুষ্ঠানে তাকে দাওয়াত দেয়া হয় না বলেও অভিযোগ করেন সভাপতিমণ্ডলীর এ সদস্য।
এরপর জবাব দেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, শাজাহান একজন দুর্বৃত্ত। উনি সব চান। নিজের ছেলেকে ছাত্রলীগের সভাপতি বানাতে চান, মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতিকে বানাতে চান স্ত্রীকে। অন্য সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বে আত্মীয় স্বজনকে চান। উনি আওয়ামী লীগকে পারিবারিক লীগ বানাতে চান। কেন্দ্রীয় নেতাদের এমন বাহাস দলীয় সভাপতি মনযোগ দিয়ে শোনেন। এরপর শাজাহান খানকে উদ্দেশে করে শেখ হাসিনা বলেন, আপনি মুরব্বি। সবাইকে নিয়ে দলটা করবেন। আপনার রাজপথে অনেক অবদান রয়েছে। আমাদের দুঃসময়ে ছিলেন। নৌকা নিয়ে ৫ বার এমপি হয়েছেন। আপনি কেন ভাগ চাইবেন? সব আপনারই হবে। আপনার করে নিতে হবে। আপনি যদি নাছিম, গোলাপসহ সবাইকে ডাকেন, কেউ কি আপনাকে ফেলে চলে যেতে পারবে? কেউই উপেক্ষা করতে পারবে না।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী ঠাট্টারছলে বলেন, আগে আপনাকে (শাজাহান খান) আওয়ামী লীগ হতে হবে। পদে থাকলেই হবে না, আওয়ামী লীগকে ধারণ করতে হবে। ব্যক্তি চিন্তা না করে, আওয়ামী লীগের চিন্তা করুন।
বৈঠকে নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস এমপি ও সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল এমপির দ্বন্দ্ব নিয়ে বিষদ আলোচনা হয়। দীর্ঘদিন দুই নেতা দুই মেরুতে অবস্থান করছেন। এর আগে সভাপতি আবদুল কুদ্দুস অভিযোগ করেছিলেন সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল তাকে নাটোর শহরে ঢুকতে দেন না। এছাড়াও শিমুলের সঙ্গে জেলার অন্য এমপিদেরও সম্পর্ক ভাল নয় বলেও বিভাগীয় সাংগঠনিক রিপোর্টে উঠে আসে। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক পিন্স এমপির একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও আলোচনা করা হয়। নাটোর, পাবনা জেলার কোন্দল নিরসনের জন্য দ্রুত সম্মেলন দিতে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা। এ সময় আগামী ৬ নভেম্বর নাটোর জেলা ও পাবনা ৭ নভেম্বর জেলা সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এছাড়াও নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, শরিয়তপুরসহ বিভিন্ন মেয়াদ উত্তীর্ণ জেলাগুলোকে দ্রত সম্মেলনের তাগিদ দেন শেখ হাসিনা।
বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, মেইনলি ৮টি বিভাগের ৮ জন সাংগঠনিক সম্পাদকের বক্তব্য তিনি (নেত্রী) শুনেছেন কার্যনির্বাহী সভায়। চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক দেশে নেই, সেখানে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম তার বক্তব্যে চট্টগ্রাম বিভাগের রাজনৈতিক চিত্র তুলে ধরেছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগের অন্য নেতারা ৮ বিভাগের ওপর নিজেরা লিখিত রিপোর্ট করেছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা তাদের এলাকার ইউনিয়ন ওয়ার্ড পর্যন্ত রাজনৈতিক চিত্র কী তা জানিয়ে রিপোর্ট উত্থাপন করেছেন নেত্রীর সামনে। যেখানে যেখানে সাংগঠনিক সমস্যা আছে এবং যেগুলো সমাধান করা দরকার, সেগুলোর ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন দলীয় সভাপতি। কিছু কিছু ছোটখাটো কলহ-বিবাদ আছে, সেগুলোও মীমাংসা করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘পাবনায় গত পৌরসভা নির্বাচন উপলক্ষে অনেকেই বিদ্রোহ করেছেন, পৌর এবং সদর এলাকার নেতারা। তারা ক্ষমা চেয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন; প্রায় ২০ জন নেতা। তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। আবার উনি (শেখ হাসিনা) এটাও বলেছেন, যারা দলের ডিসিপ্লিনের বাইরে কাজ করেছেন, বিভিন্ন জায়গায় তাদের বিরুদ্ধে তাত্ক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের ব্যাপারে ছাড় দেয়া যাবে না।’ নোয়াখালীর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানান ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখানে কোনো কথা হয়নি। সাংগঠনিক সম্পাদক স্বপন আলাপ-আলোচনা করে একটা কাঠামো তৈরি করেছে নোয়াখালীর কমিটি নিয়ে। এ ব্যাপারে নেত্রীও অবহিত আছেন। স্বপন এখন দেশের বাইরে আছে। ফিরে এলে প্রকাশ করা হবে। দলের বিভিন্ন উপ-কমিটিগুলোর সেমিনারের মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচনের যে ইশতেহার হবে, সেখানে যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে; সেগুলো আপডেট করার জন্য উপ-কমিটিগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়।’