প্রতিটি বিশেষ দিনের বিশেষ আদব বা শিষ্টাচার রয়েছে। পবিত্র মাহে রমজানের গুরুত্ব ও মাহত্বের বিবেচনায় এমাসটির দিনগুলোরও বিশেষ শিষ্টাচার রয়েছে। মানুষের ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির দিক বিবেচনায় রমজান মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। এমাসের শিষ্টাচার সম্পর্কে জানা থাকলে আমরা মাসটিতে যথাযথ আমল করে উপকৃত হতে পারবো এবং একই সাথে উদাসীনতা বা না মানার কারণে এটাও সম্ভব যে, এই মাসে কষ্ট করেও আল্লাহর রহমত-বরকত থেকে আমাদের বঞ্চিত হতে হবে। পবিত্র রমজান মাসের প্রস্তুতির জন্য রাসূল সা., তাঁর পবিত্র রক্তজ বংশধর আহলে বাইত ও আওলিয়ায়ে কেরামের অনেক নির্দেশনা রয়েছে। যার মধ্যে ইস্তেগফার, সম্পদ পবিত্রকরণ ও অন্যকে দান করা অন্যতম।
তওবা ও ইস্তেগফার :
খাজা আবা সালত নামে প্রসিদ্ধ আব্দুস সালাম বিন সালেহ হেরাভি বলেন, শাবান মাসের শেষ জুমার দিনে নবী বংশের অষ্টম ইমাম হযরত আলী ইবনে মুসা আর রেজা আ.-এর সমীপে উপস্থিত হয়েছিলাম। তিনি বললেন, “হে আবা সালত! শাবানের অধিকাংশ দিন শেষ হয়ে গিয়েছে এবং এটিই শেষ জুমা। এমাসের অসম্পূর্ণাতাকে পূর্ণ করো। পরকালে যা তোমাকে সাহায্য করবে তার বন্দোবস্ত করো এবং যা তোমার কোন কাজে আসবে না তা ছুড়ে ফেল। তোমার সামনে আল্লাহর মাস উপস্থিত, যা তোমাকে পবিত্র করে দিবে যদি না ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দিয়ে থাকো। বেশী বেশী কোরআন তেলাওয়াত, ইস্তেগফার ও গুনাহ থেকে তওবা করো। আর অন্তরে কোন মুমিনের প্রতি কুধারণা ও শত্রুতা রাখবে না। যে গুনাহগুলোতে ডুবে রয়েছো সেগুলো থেকে ফিরে আসো। সবার আগে অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করো এবং তাঁর প্রতি তাওয়াক্কুল করো, কেননা “আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।” আর শাবান মাসের দিনগুলো অবশিষ্ট থাকতেই বলো, “আল্লাহুম্মা ইন লাম তাকুন কাদ গাফারতা লানা ফি-মা মাজা মিন শা’বান ফাগফির লানা ফি-মা বাকা মিনহু।” ”হে আল্লাহ! শাবান মাসের যে অংশ অতিক্রান্ত হয়েছে, সে অংশে যদি ক্ষমা না করে থাকো তবে যে দিনগুলো অবশিষ্ট রয়েছে সে দিনগুলোতে ক্ষমা করে দাও। কেননা আল্লাহ তায়ালা এই মাসে (রমজানে) বহু মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করে দেন।”
সম্পদ পবিত্রকরণ :
মাহে রমজানের জন্য অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি হলো হালাল খাদ্য খাওয়া। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবিষয়ে একটু অমনোযোগি হলে মাহে রমজানে সমস্ত ইবাদত ও নেক আমল ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, কেয়ামত দিবসে একদল মানুষ পাহাড় পরিমাণ আমল নিয়ে আসবে কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের কিছুই গ্রহণ করবেন না, তারপরে নির্দেশ দেয়া হবে, তাদের কোন আমল না থাকায় আগুনে ফেল দাও। হযরত সালমান ফারসী রা. জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তারা কোন শ্রেণীর মানুষ? রাসূল সা. বললেন, তারা ঐ সকল লোক, যারা রোজা রেখেছিল, নামাজ আদায় করেছিল এবং রাতে জেগে নেক আমল করেছে কিন্তু যখনই তাদের সামনে হারাম সম্পদ এসেছে, তারা কোন বাছ-বিচার করেনি। রাসূল সা. বলেছেন, ইবাদতের সাথে সাথে হারাম সম্পদ ভক্ষণ করা মরুভূমির বালুর উপর ঘরের ভিত্তি স্থাপন করার ন্যায়।
সম্পদের হক আদায় না করা তথা জাকাত প্রদান না করা বর্তমান সময়ে একটা বড় সমস্যা। যা সম্পদকে অপবিত্র করে দেয় এবং এধরণের সম্পদের ব্যবহার মানুষের ইবাদত ও রোজায়ও খারাপ প্রভাব ফেলে। যে সম্পদ হস্তগত হয়েছে সেগুলোর প্রতি লক্ষ রেখে সাথে সাথে তা হিসাব করে জাকাত আদায় করা পবিত্র রমজানের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে উত্তম কাজ। এদ্বারা এমাসে যে সম্পদ ব্যয় করা হবে তা পবিত্র করা হয়ে যাবে এবং সাথে সাথে যে ইবাদত করা হতে তাও অপবিত্র সম্পদের কারণে কলুষিত হবে না।
সবাইকে ক্ষমা করে দেয়া :
রমজান মাস শুরু হওয়ার আগে শাবান মাস, যা ক্ষমা ও ইস্তেগফারের মাস। এ মাসে উত্তম হবে যারা আমাদের হক নষ্ট করেছে বা আমাদের সাথে অসদাচারণ করেছে তাদের ক্ষমা করে দেয়া এবং একই সাথে আাল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। আমরা যদি একে অন্যকে ক্ষমা করতে না পারি তাহলে কীভাবে আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে ক্ষমার আশা করতে পারি? একারণেই মাহে রমজান শুরু হওয়ার আগেই যে কাজটি করা দরকার তা হল, অন্যকে ক্ষমা করে দেয়া এবং অন্যের প্রতি বিদ্বেষসহ সকল প্রকার শত্রুতা মুছে ফেলা।
রমজান মাসকে কেন্দ্র করে দোয়া :
পবিত্র রমজান মাসের শুরুতেই রমজানের চাঁদ দেখে দোয়া করাসহ এমাসে বিভিন্ন দোয়া ও আমলের কিতাবে বর্ণিত দোয়া পাঠ করা এবং দোয়ায় আল্লাহর কাছে চাওয়া। দোয়া মানুষের মাঝে আধ্যাত্মিক পরিবেশ এবং আত্মিক শক্তি তৈরী করে দেয় এবং সাথে সাথে দোয়া মুসলমানদের অন্তরে এই মহান মাসকে সাদরে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরী করে।
রমজানের বাহ্যিক ও আত্মিক দিক :
বিশ্বের যা কিছু বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান তার একটা বাতেন বা গোপন দিকও রয়েছে। আল্লাহর বিধানসমূহ যা পৃথিবীতে মানুষের জন্য দ্বীন বা ইবাদতের নির্দেশ তারও একটা গোপনীয় দিক রয়েছে। সময় ও স্থানেরও একটা বাহ্যিক ও দৃশ্যমান দিক রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম একটি সময় হলো পবিত্র রমজান মাস। ইসলামী সংস্কৃতিতে রমজান মাস বছরের অধিক সম্মানিত ও অন্যতম মাস। যে মাসটি মুসলমানদের নিকটে ইবাদত ও পবিত্রতার মাস আর তা রাসূল সা.-এর ঘোষণা অনুযায়ী আল্লাহর মাস।
ইমাম জয়নুল আবেদীন আ. রমজান মাসকে স্বাগত জানিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সহিফায়ে সাজ্জাদিয়ায় বর্ণিত হয়েছে এবং সেখানে রমজানের প্রকৃত অবস্থা স্পষ্ট হয়েছে। আমরা তা থেকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ উল্লেখ করবো। ইমাম এই দোয়ায় প্রথমে তাঁকে দ্বীনের দিশা দেয়া, বন্দেগী ও ইবাদত করার নেয়ামত দান করার জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন :
“আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা যিনি তাঁর পথে চলার জন্য নিজের মাস রমজানকে নির্বাচন করেছেন। রোজার মাস, ইসলামের মাস, পবিত্রতার মাস, পরীক্ষার মাস, রাত্রি জাগরণের মাস, যে মাসে মানুষকে পথ দেখানোর জন্য কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং তা সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট আলামত। এসব কারণেই অন্য মাস থেকে এমাসের উৎকৃষ্টতা ও অনেক অনেক সম্মান এবং এবিষয়গুলিই মাসটির গোপন মর্যাদাগুলোকে প্রকাশ করেছে।
রমজান মাস ইসলামে সতর্ককারী ও কোরআর অবতীর্ণের মাস। ইমাম জয়নুল আবেদীন আ.-এর মতে রমজান মাস ইসলামের প্রকৃত দ্যুতি, অর্থাৎ মহান স্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পণ। এসময়ে আল্লাহর বান্দারা তাঁর নির্দেশ পালন ও তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য প্রাকৃতিক ও হালাল চাহিদাগুলো থেকেও বিরত থাকে এবং নিজেকে এক ও অদ্বীতিয় স্রষ্টার সমীপে সমর্পণ করে। বিভিন্ন চাহিদা থেকে নিজ আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করার এই মাসব্যাপী অনুশীলন সারা বছরের জন্য অনেক উপকারী। কেননা যে ব্যক্তি একমাস আল্লাহর আাদেশে নিজের হালাল চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করে শুধুমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্য পানাহারের মতো প্রাকৃতিক চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করবে সেটা বছরের এগারো মাস শয়তান ও নিজের আত্মার সাথে সংগ্রাম করার শক্তি যোগাবে এবং ঐ ব্যক্তি তাকওয়ার অধিকারী হয়ে সফলকাম হয়ে যাবে।
পবিত্রতার মাস মোবারকময় রমজান। যে মাসে বান্দা নিজেকে সকল প্রকার বস্তুগত ও অবস্তুগত চাহিদা থেকে দূরে থেকে রোজা রেখে শরীরের পবিত্রতা অর্জন করে। এর দ্বারা জীবনের পবিত্রতাও অর্জিত হয় এবং মানুষ আত্মিক পবিত্রতা ও উকর্ষ সাধনের সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালার হেদায়াতের আলো দ্বারাও উপকৃত হয়।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, রমজান মাসের প্রকৃত অবস্থা হলো ব্যক্তি ও আত্মীক স্বাধীনতাকে শৃংখলে আবদ্ধ করে আল্লাহর গোলামীতে সমর্পণ করা। রমজান মাস মহান স্রষ্টার রঙ্গে রঙ্গীন হওয়ার মাস এবং যার গোপন উদ্দেশ্য হলো আাল্লাহর সান্নিধ্য লাভ। হাদীসে কুদসীতে রোজাদারদের জন্য এভাবে এসেছে, ‘আস-সওমু লী ওয়া আনা আজঝি বিহি” যার অর্থ রোজা আমার জন্য আর এর প্রতিদান আমি নিজেই দান করবো। এ হাদীসের শেষ শব্দ যদি মাজহুল উজঝি বিহি পড়া হয় তাহলে তার অর্থ হয়, রোজা আমার জন্য আর এর প্রতিদান আমি নিজে যা হলো রোজাদারদের সাথে মহান প্রভূর সাক্ষাৎ।
লেখকঃ সাবেক শিক্ষার্থী, আল মোস্তফা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, মাশহাদ, ইরান।