মোঃ ইব্রাহিম হোসেনঃ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০১তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ।
আজ ১৭ মার্চ ২০২১ রোজ বুধবার সকালে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সংগ্রামী সভাপতি শেখ বজলুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি’র নেতৃত্বে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে এ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এ সময় ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী এবং ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের আওতাধীন বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা শেখ সায়েরা খাতুন। কালক্রমে তার হাত ধরেই বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে এই দিনে বয়স হত ১০১ বছর। আর ঠিক নয় দিন বাদেই ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ দুই বিশেষ উপলক্ষ ঘিরে বুধবার শুরু হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ে দশ দিনের অনুষ্ঠানমালা, যা শেষ হবে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির দিনে।
২০২০ সাল ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী। বছরব্যাপী জাতির জনকের জন্মশত বার্ষিকীর অনুষ্ঠান সরকারি এবং বেসরকারিভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। কিন্তু করোনার প্রকোপে অনেক কর্মসূচি স্থগিত করা হয়, যা এবার উদযাপিত হতে যাচ্ছে। এছাড়া মুজিববর্ষের কলেবরও কিছুদিন বাড়ানো হয়েছে। সরকারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী এ বছরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুজিববর্ষ পালিত হবে।
দিনটি উপলক্ষে বুধবার সারাদেশে সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এবার পালিত হতে যাচ্ছে টানা ১০ দিনের অনুষ্ঠান। যাতে বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য বিদেশি অতিথিরা অংশ নেবেন। ‘মুজিব চিরন্তন’ শিরোনামে এ ১০ দিনের অনুষ্ঠান চলবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে আগামী রবিবার (২১ মার্চ) সকাল ১১টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। যাতে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মুজিব শতবর্ষ উৎযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির উদ্যোগে ১০ দিনের কর্মসূচিতে থাকছে-১৭ মার্চের আয়োজনের থিম ‘ভেঙেছে দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়’। এদিন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ প্রধান অতিথি থাকবেন। সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইবরাহীম মু. সালেহ উপস্থিত থাকবেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ভিডিওবার্তা দেবেন।
১৮ মার্চ আয়োজনের থিম ‘মহাকালের তর্জনী’। সে অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন। ১৯ মার্চের অনুষ্ঠান ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা’। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে উপস্থিত থাকবেন। ২০ মার্চ ‘তারুণ্যের আলোকশিখা’। এই অনুষ্ঠানে ওআইসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ড. ইউসেফ আল ওথাইমিন শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন। ২১ মার্চের আয়োজন ‘ধ্বংসস্তূপে জীবনের গান’, এতে দেশীয় একাডেমিশিয়ানরা বক্তব্য দেবেন। ২২ মার্চের আয়োজন ‘বাংলার মাটি আমার মাটি’। এদিন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারী উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা শুভেচ্ছা বার্তা দেবেন। ২৩ মার্চ ‘নারীমুক্তি, সাম্য ও স্বাধীনতা’, এদিন ইউনেস্কোর ডিজি উপস্থিত থাকবেন। ২৪ মার্চ ‘শান্তি-মুক্তি ও মানবতার অগ্রদূত’, সেদিন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং উপস্থিত থাকবেন। পোপ ফ্রান্সিস শুভেচ্ছা বার্তা দেবেন। ২৫ মার্চ ‘গণহত্যার কালরাত্রি ও আলোকের অভিযাত্রা’। এদিন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চুং স্যু-কুয়েন এবং তাকাশি হাওয়াকাওয়ার পুত্র ওসামু হাওয়াকাওয়া শুভেচ্ছাবার্তা দেবেন। ২৬ মার্চের আয়োজন ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর ও অগ্রগতির সুবর্ণরেখা’। এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত থাকবেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থাকবেন।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্কুলজীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কৈশোরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে প্রথমবারের মতো কারাবরণ করেন বঙ্গবন্ধু। ম্যাট্রিক পাসের পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের মতো রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন। এ নেতাদের সাহচার্যে তিনি নিজেকে ছাত্র-যুব নেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর পরই ঢাকায় ফিরে নতুন রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা নিয়ে অগ্রসর হন বঙ্গবন্ধু। সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হলে তরুণ নেতা শেখ মুজিব দলটির যুগ্ম সম্পাদক পদ পান। পরে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নামকরণ করা হয় আওয়ামী লীগ।
বঙ্গবন্ধু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, আটান্নর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনসহ পাকিস্তানি সামরিক শাসনবিরোধী সব আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাঙালির অধিকার আদায়ের এসব আন্দোলনের কারণে বারবার কারাগারেও যেতে হয় তাকে। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান পান। আওয়ামী লীগ প্রধান হিসাবে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন তথা বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে তাদের কারাগারে পাঠান। ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালি শেখ মুজিবকে কারামুক্ত করে। এ সময়ে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নানা চক্রান্ত করে বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। এরপর বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলন এবং চূড়ান্তপর্বে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ দেন।
এ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মার্চে নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এরই ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু বেশিদিন দেশ গঠনের কাজ করে যেতে পারেননি। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে নিজ বাসভবনে ক্ষমতালোভী ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নিহত হন। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জীবনাবসান ঘটে।