মোঃ ইব্রাহিম হোসেনঃ ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু’। বিখ্যাত সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার সেই কালজয়ী গান ‘মানুষ মানুষের জন্যে’ আজও মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়। আজও মানুষকে ভাবায়। মানুষের চেতনাকে শাণিত করে; জাগিয়ে তোলে। ভূপেন হাজারিকা আমাদের মাঝে নেই। আছে তাঁর গান। মানুষ বিপদাপন্ন হলে এই গান যেন আরো বেশি করে আমাদের মাঝে ফিরে ফিরে আসে।
আমরা মানুষ হয়ে অসহায় মানুষের পাশে কি দাঁড়াচ্ছি? অবশ্যই অনেকে দাঁড়াচ্ছেন। ডাঃ মোঃ আন্দুল্লাহ আল কাফি তিনি গরীব ও দুঃস্থ রোগীদের সাশ্রয়ী মূল্যে ছানি ও রেটিনার অপারেশন করে যাচ্ছে।
ডাঃ মোঃ আন্দুল্লাহ আল কাফি বলেন, ২০০৯ সালের একটা ঘটনাই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে আমি সহকারী রেজিস্ট্রার হিসাবে তিন মাসের মতো হলো, ঐ ক্যাম্পাসের কোর্য়টারে থাকি, কোথাও চেম্বার প্রাকটিস করি না। বিকেল বেলা ঠিক মাগরিবের নামাজের কিছু পূর্বে, আমার কাছে দুইজন গরীব মানুষ পরনে লুঙ্গি ও জামা, দু’জনের বয়সই ৬০ বছরের উপরে, হাসপাতালের গেটে আমাকে দেখে হাসতে হাসতে কাছে এসে বললেন, আমরা আমাদের ডাক্তারকে পেয়ে গেছি। আমি তো তাঁদেরকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারিনি, কারন প্রতিদিন আউটডোরে এতো রোগী দেখতে হয় যে কাউকে আলাদা করে মনে রাখা সম্ভব না। একজন তাঁর পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে আমাকে দেখতে দিলেন। কাগজ দেখে বুঝলাম, একজনের চোখে ছানি আছে, সব পরীক্ষা-নিরিক্ষা করা আছে, আগামীকাল সোমবার তাঁকে হাসপাতালে ভর্তির উপদেশ দেওয়া আছে। আমি বললাম, আজতো রবিবার আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে আগামীকাল সোমবার সকালে। ওনারা বললেন, আমরা সাতক্ষীরা থেকে এসেছি, রাতে রওনা দিয়ে যদি সকালে ঠিক সময়ে হাসপাতালে না আসতে পারি, তাই বুদ্ধি করে আজকেই চলে এসেছি। আমি বললাম, রাতে থাকবেন কোথায়? দু’জনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বললেন, তাতো জানি না, তবে আপনাকে যখন পেয়ে গেছি, আপনিই একটা ব্যাবস্থা করে দেন। আমি তাদেরকে নিয়ে হাসপাতালের গেটে গেলাম। হাসপাতালের র্গাডদেরকে আমার পক্ষথেকে কিছু বকশিস দিয়ে ওনাদেরকে রাতে হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করলাম। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আনমনে ভাবছি আর চিন্তা করছি, ঢাকা শহরে যদি আমার এরকম একটা ব্যবস্থা থাকতো তাহলে এরকম গরীব, অসহায় গ্রামের মানুষদেরকে আমি এই ঢাকা শহরে একরাত বিনা পয়সায় রাখতে পারতাম। রাতে মহান আল্লাহর দরবারে অসংখ্যবার এই ব্যাপারে সাহায্য প্রার্থনা করলাম। মাত্র ছয় মাসের মাথায় মহান আল্লাহর রহমতে ঠিক যা আমি চাচ্ছিলাম, সেই ব্যবস্থা হয়ে গেল। লাখো-কোটি শুকরিয়া মহান আল্লাহর দরবারে।
দুই. খুব ভালভাবেই চলছিল সবকিছু ২০১১,২০১২, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সাল পর্যন্ত। ২০১৬ সালে আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি সহ আমরা অর্জন করেছি অনেক কিছু। নিজস্ব চক্ষু হাসপাতালে মহা সমারোহে অসহায় গরীব মানুষের জন্য চক্ষু চিকিৎসার নতুন দ্বার উম্মোচন করবো, চক্ষু বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে। চোখের পাপড়ি থেকে রেটিনা পর্যন্ত সবকিছুর চিকিৎসা শুরু হবে একটি ছাদের নীচে। কিন্তু কথায় বলে, সাত ছেলের মা গঙ্গা পায় না, ঠিক তাই হলো। ডিসেম্বর ২০১৬ সাল, আমরা আর আমরা না থেকে হয়ে গেলাম শুধুই আমি। ২০১৭ সালের জানুয়ারী থেকে শুরু হলো একলা চলার পথ, যে পথ ধরে তৈরী হলো এই ”শ্যামলী চক্ষু হাসপাতাল”।
তিন. রিং রোডে ৩/ক, বাসাটি পূর্বে ছিল বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির একটি শাখা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ওনারা বাসাটি ছেড়ে দিলেন। এই বাসাটিই আমি ভাড়া নিলাম, আমার চেম্বারের জন্য। চেম্বারের নাম দিলাম, শ্যামলী চক্ষু হাসপাতাল। জীবনের এই কঠিন সময়ে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন আরসে আজীম থেকে পাঠিয়ে দিলেন শত শত মানুষ রুপী ফেরেশতাকে, আমি আমার এক জীবনে কখনই তাদের ঋৃন শোধ করতে পারবো না। আল্লাহর কাছে লাখো-কোটি শুকরিয়া, আল্লাহ যেন সেই সমস্ত মানুষদের (রোগী, রোগীদের আত্মীয়-স্বজন, আমার অসংখ্য শুভাকাংখী, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, সহযোদ্ধা, মেডিকেল ইকুপমেন্ট কোম্পানীর মালিক-কর্র্মকর্তা-কর্মচারী, বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানীর মালিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী, এছাড়াও আমার অসংখ্য শুভানুদ্ধায়ী) সারা জীবনের সম¯ত গুনাহ গুলি ক্ষমা করে দেন, তাদের কবরকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দেন, রোজ হাশরে তাদের সকলকে আমার প্রানপ্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর শাফায়েত নসিব করেন। যাদের সাহায্য সহযোগীতায় আমি ১৩ই জানুয়ারী ২০১৭ হইতে ২৫শে এপ্রিল ২০১৭ মাত্র তিনমাসে একটি স্বপ্নের বাস্তব রুপ দিতে সক্ষম হই। আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন যেন এই প্রতিষ্ঠানটিকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সাশ্রয়ী রেটে চক্ষু চিকিৎসার একটি নির্ভরযোগ্য আস্তাভাজন প্রতিষ্ঠানে পরিনত করতে পারি।
ডাঃ মোঃ আব্দুল্লাহ আল কাফি সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ
জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৪ শে মার্চ। দিনাজপুর জেলার পার্ব্বতীপুর থানার ১০ নং হামিদপুর ইউনিয়ন। গ্রামের নামঃ – মৌ-পুকুর। ১৯৮৫ সালে ফুলবাড়ী জি এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএস সি ও ১৯৮৭ সালে কারমাইকেল কলেজ রংপুর থেকে এইচ এস সি পাশ করেন। ১৯৮৮ সালে মানব সেবার মহান ব্রত নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ১ম বর্ষে ভর্তি হয়ে ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর সেশনে এমবিবিএস ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন। ২০১১ সালে বি এস এম এম ইউ থেকে চক্ষু বিষয়ে এম এস ডিগ্রী শেষ করেন । ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে চোখের বিভিন্ন সাব-স্পেশিইয়ালিটিতে কাজ করেন। ২০১৭ সালে দেশের গরিব জনগনের জন্য এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন।