মোহাম্মদ ইরফান।।
রাজধানীতে মানবপাচার ও প্রতারক চক্রের মূলহোতাসহ ৪ সদস্য গ্রেফতার করেছে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। র্যাব জানায়, ভুয়া ভিসা এবং ভুয়া টিকেট সরবরাহ করে মানুষের সাথে তারা প্রতারণা করে। তাদের জনশক্তি রপ্তানির কোনো লাইসেন্স নেই। কিন্তু তারা দীর্ঘদিন ধরে জনশক্তি রপ্তানির নামে অবৈধভাবে ভ্রমণ ভিসার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে লোক প্রেরণ করে আসছে। বিশেষ করে সৌদি আরবে।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন, কামরুল আহম্মেদ (৪২), মো.খালেদ মাসুদ হেলাল (৩৬), তোফায়েল আহম্মেদ (৩৮) ও মো. জামাল (৪২)। এসময় তাদের কাছ থেকে ২৭টি পাসপোর্ট, ১টি মনিটর, ১টি সিপিইউ, ১টি মাউস, ১টি কীবোর্ড, ১টি ইউপিএস, ১০০টি ভিসার কপি, ১২৫টি টিকেট, ৪টি মোবাইল ফোন, ২টি ফরম বই কোভিড-১৯ নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা (আরটি-পিসিআর) এবং ১টি প্রিন্টার জব্দ করা হয়। শুক্রবার (১৬ এপ্রিল) রাতে রামপুরা ও হাতিরঝিল এলাকায় চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
শনিবার (১৭ এপ্রিল) দুপুর ১২টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধান ও আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত আসামিরা সংঘবদ্ধ মানবপাচার ও প্রতারক চক্রের সদস্য। কামরুল এ চক্রের মূলহোতা এবং অপরাপর গ্রেফতারকৃত আসামিরা তার সহযোগী। তাদের জনশক্তি রপ্তানির কোনো লাইসেন্স নেই। কিন্তু তারা দীর্ঘদিন ধরে জনশক্তি রপ্তানির নামে অবৈধভাবে ভ্রমণ ভিসার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে লোক প্রেরণ করে আসছে। এছাড়াও উক্ত চক্র মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে জনশক্তি প্রেরণের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশ গমনে ইচ্ছুক বেকার ঘরক যুবতিদের নিকট থেকে ৫ থেকে ৭ লক্ষ টাকা করে হাতিয়ে নিয়ে ভুয়া ভিসা এবং ভুয়া টিকেট ভুক্তভোগীদের হাতে ধরিয়ে দেয়। ভুক্তভোগীরা ভিসা এবং টিকেট নিয়ে বিমানবন্দরে গেলে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের ভিসা এবং টিকেট জাল হওয়ায় বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেন। ভুক্তভোগীরা এবিষয়ে প্রতিকার চাইলে আসামিরা তাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে বাসার ঠিকানা পরিবর্তন করে দেয়। এভাবে গত ২ বছরে আসামিরা আটবার বাসার ঠিকানা পরিবর্তন করে। গত ৫ বছরে উক্ত চক্র অবৈধভাবে শতাধিক লোককে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করে। যারা বিদেশ গিয়ে কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অন্যদিকে এই চক্র শতাধিক লোককে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রেরণের প্রলোভন দেখিয়ে জনপ্রতি ৫ থেকে লক্ষ টাকা করে হাতিয়ে নিয়ে ভুয়া ভিসা এবং ভুয়া টিকেট সরবরাহ করে প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
সংবাদ সম্মেলনে লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, চক্রের মূলহোতা আসামি কামরুল নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। তার কোনো নির্দিষ্ট পেশা নেই। প্রতারণা এবং মানবপাচারই তার পেশা। ২০১৯ সালে সে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই যায়। তারপর সেখানে মানবপাচারের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে দুবাই এর রেসিডেন্স ভিসা লাভ করে এবং একটি প্রাইভেটকার ক্রয় করে নিজে ড্রাইভিং করে ভাড়ায় উক্ত প্রাইভেটকার পরিচালনা করে অর্থ উপার্জন করে। বিশ্বে করোনার প্রাদুর্ভাব হলে উক্ত প্রাইভেটকারটি বিক্রি করে ২০২১ সালের মে মাসে। সে বাংলাদেশে ফিরে এসে পুনরায় প্রতারণা এবং মানবপাচারকে তার পেশা হিসেবে বেছে নেয়। তার জনশক্তি রপ্তানির কোনো লাইসেন্স নেই। সে বিভিন্ন টুরস ও ট্রাভেলসের সাথে যোগাযোগ করে অবৈধভাবে ভ্রমণ ভিসায় বিভিন্ন দেশে লোক প্রেরণ করে। যারা বিদেশ গিয়ে কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এছাড়াও সে প্রতারণামূলকভাবে জনপ্রতি ৫ থেকে ৭ লক্ষ টাকা করে হাতিয়ে নিয়ে ভুয়া ভিসা এবং ভুয়া টিকেট সরবরাহ করে প্রায় পাঁচশতাধিক লোকের নিকট হতে ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। কামরুলের নামে চট্টগ্রাম কোর্টে একটি চেক জালিয়াতির মামলা এবং মৌলভীবাজার কোর্টে ডাচ বাংলা ব্যাংকে ১৮ লক্ষ টাকার একটি মামলা রয়েছে। তার বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩৮ লক্ষ টাকার উপরে আছে।
তার অন্যতম সহযোগী জামাল মাহবুব ইন্টারন্যাশনাল এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। মাহবুব ইন্টারন্যাশনাল মানবপাচারের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় বিএমইটি কর্তৃক তাদের লাইসেন্স ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। একমাস পূর্বে মাহবুব ইন্টারন্যাশনালের এমডি মানবপাচারের দায়ে র্যাব-৩ কর্তৃক গ্রেফতার হয়। আসামি জামাল সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। পাঁচ বছর ধরে সে কামরুলের সাথে প্রতারণা এবং মানবপাচারের কাজ করে আসছে। জামালের নামে একটি মাদক মামলা রয়েছে।
আসামি খালেদ ২০০১ সাল থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর সৌদিআরবে ছিল। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ফেরত এসে সে রাজনগর মৌলভীবাজারে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু উক্ত ব্যবসায় সে সফল হতে না পেরে কামরুলের সাথে প্রতারণা ও মানবপাচারের কাজে যোগ দেয়। সে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে।
আসামি তোফায়েলের পেশা ড্রাইভিং। এছাড়াও মৌলভীবাজারে তার সিএনজি পার্টস এবং ডেকোরেটরসের ব্যবসা রয়েছে। অতি লাভের আশায় সে কামরুলের সাথে প্রতারণা ও মানবপাচারের কাজে যোগ দেয়। কামরুলের বড় ভাইয়ের মাধ্যমে কামরুলের সাথে তার পরিচয় হয়। জব্দকৃত ভিকটিম গ্রেফতারকৃত তোফায়েলের গ্রাম সম্পর্কীয় আত্মীয়। ভিকটিমের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তার সম্ভ্রম নষ্ট করার লক্ষ্য নিয়েই সে ভিকটিমকে সৌদিআরবে প্রেরণের প্রলোভন দেখিয়েছিল। এরপর সে ভিকটিমকে কৌশলে ঢাকায় নিয়ে এসে কামরুলের বাসায় আটক রেখে তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। র্যাবের অভিযানে ভিকটিম উদ্ধার হয়। আসামি তোফায়েলের নামে একটি চুরি মামলা রয়েছে।
গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।