লেখক: মাওলানা সাইফুল ইসলাম সালেহীঃ আমাদের সমাজে অন্যায় অপরাধ অত্যচার জুলুম অনেক বেশী বেঁড়ে গেছে, ভালবাসা মায়া মমতা ও মানবতা একদম কমে গেছে। সমাজের মধ্যো কেউ প্রতিহিংসা আর অন্যজনের ক্ষতি করতে ব্যস্ত থাকে, একে অপরের সমালোচনায় ও দোষ ক্রটি নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকে। সুদ ঘুষ মদ পান ও সম্পদ আত্মসাৎ বেঁড়ে যাচ্ছে, সমাজে দুর্বল লোকদের প্রতি বেশী অত্যাচার ও জুলুম করা হচ্ছে। সুদ ঘুষ ও দুর্নীতি করে যারা বড় লোক হচ্ছে তাঁরা সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। মানুষ মানুষকে বহুভাবে সৃজনশীল ঠকিয়ে দিচ্ছে। যারা ব্যবসা করে তাঁরা বহু রকমের কাষ্টমার কে ঠকিয়ে দিচ্ছে ও ওজনে কম দিচ্ছে। মানুষ ভুলে গেছে পরকাল ও জাহান্নামের আগুনকে। সমাজের মানুষের যদি আল্লাহর ভয় থাকতো পরকালের ভয় থাকতো ও জাহান্নামের ভয় থাকতো তাহলে এই সব অন্যায় অপরাধ জুলুম করতো না। এই সব অন্যায় অপরাধ ও জুলম এর কারণে আল্লাহ তায়ালা করোনাভাইরাস দিয়ে গজব দিয়েছে, তাঁরপরেও মানুষ বুঝতেছে। এই সব অন্যায় অপরাধ ও জুলুমের কারণে পূর্বে বহু জাতিকে আল্লাহ তায়ালা ধ্বংস করে দিয়েছেন, ধ্বংস হওয়া বহু জাতির কথা মহা গ্রন্থ আল কুরআনে এসেছে। পৃথিবীতে বহু আগে সামুদ জাতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তাঁদের কথা আল কুরআনে উল্লেখ এসেছে। পৃথিবীর মধ্যে এক সময় সামুদ জাতি ছিল অর্থশালী ও শক্তিশালী ছিল। তাঁদের সুখ শান্তি কোন কিছু কমতি ছিল না, তাঁরা বড় বড় প্রাসাদ ও পাহাড় কেটে দালান কোটা নির্মান করতো। তাঁরা শিল্প ও নকসা করে পাথর দিয়ে খুব সুন্দর করে প্রাসাদ নির্মান করতো। কিন্তু তাঁরা মহান সৃষ্টি কর্তাকে ভুলে গিয়ে শুরু করে দিয়েছে পাথর পূজা মুক্তির পূজা ও দেব দেবীর পূজা, তাঁদের মধ্যে বেঁড়ে গেছে অন্যায় অপরাধ ও জুলুম নির্যানত। আদ জাতি ধ্বংস হওয়ার ৫০০ বছর পরে এই পথভ্রষ্ট সামুদ জাতিকে আসমানি ধর্ম পালন করার জন্য আল্লাহ তায়ালা একজন তাঁর মনোনীত নবী পাঠিয়েছেন হযরত সালেহ (আ:) কে। আল্লাহ তায়ালা মহাগন্থ আল কুরআনে ইরশাদ করেন:
আমি ছামূদ সম্প্রদায়ের নিকট তাদের ভাই সালিহকে পাঠিয়েছিলাম এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর। কিন্তু তারা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে বিতর্কে লিপ্ত হল। সূরা নামল আয়াত নং ৪৫। হযরত সালেহ (আ:) সামুদ জাতিকে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার জন্য অনেকবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা কোন ভাবে তাঁদের নবীর কথা শুনলেন না ও মানলেন না। অল্প কিছু লোক ঈমান এনেছে, আর কেউ ঈমান আনয়ন করে নাই। হযরত সালেহ (আ:) তাঁদের কে বার বার আসমানি ধর্মের প্রতি দাওয়াত দিচ্ছেন ও বুঝানোর চেষ্টা করতেছেন। একপর্যায়ে হযরত সালেহ (আ:) এর আহ্বানের জবাবে তাঁরা বলল, তুমি আমাদেরই মত একজন সাধারণ মানুষ ছাড়া আর অন্য কিছুই নও, এবং মানুষ কখনও নবী- রাসূল হতে পারে না। অতএব তুমি কোন না কোন একটি মাজেযা দেখাও, যদি তুমি সত্যবাদী থাক। হযরত সালেহ (আ:) বললেন, তোমরা কিরূপ মাজেযা দেখতে চাও? তাঁরা বলল, ঐ পাহাড়টির মধ্যে হতে একটি উটনী বের হয়ে আসবে আর তা তখনই একটি বাচ্চা প্রসব করবে এবং রীতিমত তাকে দুগ্ধপান করাবে । এরূপ ঘটনা দেখতে পারলে তবেই বুঝবো যে, তুমি আল্লাহর সত্য নবী। এমন মূহূর্তে ফেরেশতা জিব্রাইল (আ:) এসে তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর নবী, আপনি তাঁদের নিকট হতে একটি ওয়াদা আদায় করুন যে, তারা যেন ঈমান আনয়ন করে। তাঁরপরে হযরত সালেহ (আ:) তাঁদের কে এই ওয়াদা গ্রহণ করালেন। ঠিক এ মূহূর্তে আল্লাহ তায়ালার দরবার হতে পুনরায় নির্দেশ আসল যে, হে সালেহ! তুমি আমার নিকট দোয়া কর কর, আমি চার হাজার বছর পূর্বেই ঐ পাহাড়ের মধ্যে একটি উটনী সৃষ্টি করে রেখেছি, যেন যথাসময়ে তোমার মাজেযা দেখতে পারে এবং তোমার নবুয়তের প্রতি ঈমান আনয়ন করে। অত:পর: হযরত সালেহ (আ:) আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটি সুন্দর উটনী ঐ পাহাড়ের ভিতর হতে বের হয়ে আসল। এইরকম সুন্দর উটনী কেউ কোনদিন দেখে নাই। উটটি বের হওয়ামাত্র একটি অতি সুন্দর বাচ্চা প্রসব করল এবং সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী চারণ ভূমিতে ঘাস খেতে আরম্ব করলেন। হযরত সালেহ (আ:) এর এই মাজেযা দেখার পরেও কেউ ঈমান আনয়ন করে নাই, সামুদ জাতি ওয়াদা ভঙ্গ করেছে । সামুদ জাতির পানি পান করার জন্য আল্লাহ তাঁদেরকে একটি কূপ দান করেছিলন। তাঁদের সাতটি গোত্রের সকলেই সে কূপ হতে পানি পান করত ও নিত, কিন্তু তাতে কূপের পানি একটুও কমতো না। উল্লিখিত উটটির চালক উটটিকে উক্ত কূপের নিকট নিয়ে গেল সে তা হতে এত বেশী পানি পান করল যে, কূপের পানি সব শেষ হয়ে গেল। হযরত সালেহ (আ:) বললেন, তোমরা একে একে সকলেই উটটিকে দোহন করে দুধপান কর। তারা সকলে দোহন করে মহা তৃপ্তিতে তার দুধ পান করল এবং অনেক বড় পাত্র ভরে দুধ বাড়িতে নিয়ে গেল, কিন্তু তাতে উটের বাটের দুধ সামান্য মাত্র কমল না। হযরত সালেহ (আ:) আল্লাহর একটি আদেশের কথা সকলকে জানিয়ে দিলেন এবং তিনি সকলকে বলে দিলেন যে, এটা কিন্তু স্বয় মহান আল্লাহ তায়ালার উট, সুতারাং তোমরা একে কোন রকম অথযা বিরক্ত করো না। যদি তা কর তা হলে কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তোমাদের কে কঠিন শাস্তি দিবেন। মহানগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ বলেন:
আর হে আমার কাওম! এটা হচ্ছে আল্লাহর উষ্ট্রী যা তোমাদের জন্য নিদর্শন। অতএব ওকে ছেড়ে দাও যেন আল্লাহর যমীনে চরে খায়, আর ওকে খারাপ উদ্দেশে স্পর্শ করনা, অন্যথায় তোমাদেরকে আকস্মিক শাস্তি এসে পাকড়াও করতে পারে। সূরা হুদ আয়াত নং ৬৪ । আল্লাহর কি অপার মহিমা! ঘটনাক্রমে ঐ মাসে দশজন মহিলা দশটি পুত্রসন্তান প্রসব করল। তাঁরা সকলে হযরত সালেহ (আ:)- এর উক্তি শুনেছিল, সুতারাং নয়জন মহিলা-ই নিজ নিজ সন্তান মেরে ফেলল; কিন্তু একজন মহিলা তাঁর সন্তান মেরে ফেলল না; বরং তাকে সে আদর-যত্নে লালন পালন করতে লাগল। ছেলেটি অত্যন্ত হ্নষ্টপুষ্ট এবং শক্তিশালী হল। ঐ ছেলেটির নাম রাখা হয়েছিল কেদাব। তাঁদের অত্যন্ত ক্ষোপ এবং বিরক্ত জন্মে গেল হযরত সালেহ (আ:) এর উপর। তারা বলতে লাগল, আমরা খালি খালি হযরত সালেহ (আ:) এর কথায় বিশ্বাস করে নিজেদের সন্তান হারা হলাম। উক্ত মহিলাদের ক্ষোপ এবার প্রতিহিংসার রূপ পরিগ্রহ করল। তাঁদের কথাবার্তা শুনে অনেকেরই আস্থা এবং বিশ্বাস হযরত সালেহ (আ:) এর উপর হতে কমে গেল। তাঁরা মনে করতে লাগল যে, একটি উটনীকে কেন্দ্র করে অনাহুত নিস্পাপ নয়টি শিশু- সন্তান অকালে প্রাণ হারাল, সুতারাং তাঁদের অনেকেই এরূপভাবে প্রতিজ্ঞাবন্ধ হল যে, ঐ উটটি কে তাঁরা হত্যা করে ফেলবে, কিন্তু একথা কেউই চিন্তা করল না যে, হযরত সালেহ (আ:) সতর্ক করে দিয়েছেন যে, উক্ত উটের প্রতি কেউ কোন রকম অসদাচরণ করলে আল্লাহর তরফ হতে কঠোর আযাব আসবে। সামুদ জাতির দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে এসেছিল। তাই শীঘ্রই একদিন উল্লিখিত কেদার ও মেছদা একসাথ হয়ে নেশার বস্তু পান করে এরূপ যুক্তি করল যে, উটটিকে হত্যা করার দায়িত্ব তারা পালন করবে । কওমের কতিপয় শরাবপায়ী তাঁদের এ ব্যাপারে আরও উৎসাহ প্রদান করল। উটটি যখন কূপের তীরে পানি পান করতে আসবে, তখনই তারা কাজ সাধন করবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। পরবর্তী দিন উটটি যখন উক্ত কূপের তীরে পানি পান করতে উপস্থিত হল, তখন কেদার একটু দূর হতে তার গ্রীবায় তীর নিক্ষেপ করে তাকে আহত করল। ঘটনাস্থলে অনেক লোক উপস্থিত ছিল, কিন্তু একটি লোকও তাকে এ খারাপ কাজ হতে বিরত রাখল না, বরং সকলে তাঁরা নীরব ছিল সম্মতিই প্রদান করল। আহত উটটি বেদনায় অস্থির হয়ে উপস্থিত জনতাকে হামলা করতে উদ্যত হলে তারা ছুটে পালাল। উটটিও পিছু পিছি তাঁদের কে ধাওয়া করে চলল। ঠিক এ মূহূর্তে মেছদা পিছনের দিক হতে দৌড়ে এসে তরবারী দ্বারা পায়ে প্রচণ্ড আঘাত হানল। পা দ্বিখণ্ডিত হয়ে উটটি লুকিয়ে পড়ল। সাথে সাথে দুষ্কৃতিকারী ছুটে এসে অস্ত্রের আঘাতে উটটিতে হত্যা করে ফেলল। উটটি হত্যা সম্পর্কিত ঘটনা পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে:
অনন্তর তারা ওকে মেরে ফেলল। তখন সে বললঃ তোমরা নিজেদের ঘরে আরও তিন দিন বাস করে নাও; এটা ও‘য়াদা, যাতে বিন্দুমাত্র মিথ্যা নেই। সূরা হুদ আয়াত নং ৬৫। হযরত সালেহ (আ:) যখন উটের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেলেন, তিনি নিজের কওমের লোকদের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, তোমরা এখন আর মাত্র তিনটি দিন দুনায়াবী আরাম- আয়েশ করে নিতে পার। কেননা তোমাদের কে যে সতর্কবাণী শুনান হয়েছে, তা কোনক্রমেই মিথ্যা হবার নয়। তোমাদের হায়াত আর মাত্র তিনদিন আছে। লোকজন জিজ্ঞেস করল, কোন পূর্ব নিদর্শন প্রকাশ পাবে কি? হযরত সালেহ (আ:) বললেন, অবশ্য প্রকাশ পাবে। তিনদিনের প্রথমদিন তোমাদের সকলের চেহারা সবুজ রং হয়ে যাবে। দ্বিতীয়দিন তা লাল রং ধারণ করবে। আর তৃতীয়দিন তোমাদের মুখমণ্ডল ও সারাদেহ ঘোর কালো রং হয়ে যাবে। তার পরবর্তী দিনে তোমাদের প্রতি নেমে আসবে আল্লাহর তায়ালার তরফ হতে গজব। হযরত সালেহ (আ:) বর্ণিত এ ধ্বংসের নিদর্শন যখন প্রকাশ পেল তখন যারা উক্ত হত্যায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, তারা হযরত সালেহ (আ:) – কে হত্যা করার উদ্দেশ্য তাঁর ঘরে যাত্রা করল, কিন্তু ইতোমধ্যেই তাদের উপরে আল্লাহর গজব পৌঁছে গেল। তখন আর নবীকে হত্যা করা তো দূরের কথা নিজেদের বাঁচার চিন্তায়ই অস্থির হয়ে পড়ল। তারা আবার দৌঁড়ে গিয়ে যার যার ঘরে আশ্রয় নিল, কিন্তু আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা জিব্রাঈল তখন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছেন। তিনি সামুদ জাতির লোকদের ঘরগুলোকে ধরে সামন্য নাড়া দিলেন আর তাতেই সেগুলো সব ভেঙ্গে চুরে একাকার হয়ে গেল। অত:পর হযরত জিব্রাইল (আ:) এমন এক প্রচন্ড হুঙ্কার দিলেন, যার হ্নদয় ফাটানো আওয়াজে সবলোক অজ্ঞান হয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা মাটির মধ্যে পড়ে গিয়ে চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেল। তাদের আর কোন চিহ্নই অবশিষ্ট রইল না। মহা গ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ বলেন:
তারা এক চক্রান্ত করেছিল এবং আমিও এক কৌশল অবলম্বন করলাম, কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি।
অতএব দেখ, তাদের চক্রান্তের পরিণাম কি হয়েছে। আমি অবশ্যই তাদেরকে ও তাদের সম্প্রদায়ের সকলকে ধ্বংস করেছি।
এইতো তাদের ঘরবাড়ী সীমা লংঘন হেতু যা জনশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে; এতে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।
এবং যারা মু’মিন ও মুত্তাকী ছিল তাদেরকে আমি উদ্ধার করেছি। সূরা আন নমল আয়াত নং ৫০,৫১,৫২,৫৩।