এডভোকেট খোন্দকার সামসুল হক রেজাঃ
২৩ জুন’ ১৯৪৯ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্টা। এর নামের বিবর্তন, এর নেতৃত্ত,এর ইতিহাস, এর সংগ্রাম এবং ঐতীহ্য নিয়ে কমবেশী সকলেরই স্পষ্ট ধারনা আছে। আর এ সংগঠনের অস্তিত্ত্বের মইধ্যে সবচেয়ে বেশী মিশে আছে, জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নাম। তার পরই জননেত্রী শেখ হাসিনার নাম। যা নিয়ে আমরা জাতি হিসেবে গর্ভ করি। পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে, যাদের আমাদের মত গর্ভ করার মত ইতিহাস আছে। এতো ছোট একটি ভূখণ্ডের, এতো বড় একটি ইতিহাস যা ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়, একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরদ্ধে নিরস্ত্র মানুষের যুদ্ধ আর যা ৭ মার্চের একটি ডাকেই সম্ভব হয়েছে। আর সেজন্যই হয়তো কিউবার মহান নেতা, ফিদেল ক্যাষ্ট্রো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে বলছিলেন,তিনি হিমালয় দেখেনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন ! । তাহলে এই দাড়ায় না, জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু, হিমালয়ের চেয়েও ভারী । আর যাকে হত্যা করেছে, আমাদের বাঙালীর কিছু কুলাঙ্গার । ভাবা যায় বিষয়টি। সারা বিশ্বের মানুষ, আমাদের কে নিয়ে, কি ভাবে। কত অকৃজ্ঞ জাতি আমরা। সারা বিশ্বের কাছে বাঙালী জাতির নামটি যিনি প্রতিষ্টা করলেন, যিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালী, তাকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি !। অথচ তিনি ছিলেন এক বিশাল হৃদয়ের মানুষ। পাকিস্থান রাজ্নীতী বা পরবর্ত্তী কালের বাংলাদেশের রাজনীতিতে, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির আজীবন বিরোধিতাকারী রাজনীতিবিদরাও বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করতেন। শুনেছি, খান এ সবুর, ফজলুল কাদের চৌধুরী, শাহ আজিজুর রহমান, মাওলানা ভাসানীর মত বড় বড় নেতারা বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করতেন। কারন বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় গুন ছিল, তিনি রাজনৈতিক কারনে, করো ব্যক্তিগত অমঙ্গল চাইতেন না বা ব্যক্তিগত শত্রুতা করতেন না। বঙ্গবন্ধু যে কত বড় মানুষ ছিলেন, তা আমার জানা ২টি ছোট ঘটনা দিয়ে বলার চেষ্টা করবো। বিগত পর্বগুলোতে এরকম বিষয় এনেছি। ১৯৭২ সনে গনপরিষদ মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদন হওয়ার পর, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সনে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের নতুন নির্বাচন দেন। বলাবহল্য আমার পিতা মরহুম এডভোকেট আব্দুল আজিজ খন্দকার, পটুয়াখালী ২ তথা বাউফল থানা আসনে ১৯৭০ এর নির্বাচনে, আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর দেয়া মনোনয়নে এম পি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সনের স্বাধীনতা যুদ্ধে পটুয়াখালী জেলার ৬ জন এম এন এ ও এম পিদের মৈদ্ধে ৩ জন সংসদ সদস্য পাকিস্থানের পক্ষে কাজ করায়, তাদের সদস্যপদ বাতিল হয় এবং আমার পিতা সহ ৩ জনের এম পি পদ বহাল থাকে এবং তারাই স্বাধীনতার পর গনপরিষদ সদস্য হন। আমার আব্বা যেহেতু পটুয়াখালী মহকুমা ও পরে পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ছিলেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সময় পটুয়াখালী জেলার মুল রাজনৈতিক নেতৃত্তে ছিলেন, সেহেতু স্বাধীনতা পরবর্তী কালে তিনিই পটুয়াখালী জেলার সকল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের মুল ভূমিকায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার আব্বাকে পটুয়াখালী আওয়ামী লীগের জীবন বলতেন। এমনই অবস্থায় ১৯৭৩ এর এম পি নির্বাচন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে , আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কার্য্যক্রম শুরু হয়। যতদুর মনে পড়ে, পটুয়াখালীর বাউফলের আসনে আমার পিতাই একাই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থী হন। পরবর্তী সময় বন্যাজনিত কারনে বরিশাল অঞ্চলে কিছু এলাকার নির্বাচন পিছনো হয় এবং মনোনয়ন আবেদনের জন্য কয়েকদিন সময় বাড়ানো হয়। ঐ সময় বাউফল আসনে, ঐ সময়ের মহকুমা আওয়ামী লীগের নেতা জনাব এডভোকেট ফোরকান মিয়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য অবেদেন করেন, যার বোনের ছেলে লন্ডনে বিরাট ব্যবসায়ী ছিলেন । ঐ সময় বাহিরে একট কথা প্রচার হয়, তিনি নাকি বঙ্গবন্ধুর ক্লাসমেট ছিলেন। নির্বাচনের নমিনেশন ঘোষণার ৩ দিন আগে,আব্বা আমাকে নিয়ে পটুয়াখালীর সবুজবাগ বাসা থেকে রিক্সায় বাজারে যাচ্ছিলেন, পথে ঐ এডভোকেট ফোরকান সাহেবের সাথে দেখা। তিনি রিক্সায় কোর্টে যাচ্ছিলেন। তিনিই আমাদের রিক্সাটি থামলেন এবং যা বললেন, তা শুনে আমার আব্বার মানুষিক অবস্থা কেমন হয়েছিল, তখন বুঝতে না পারলেও এখন ভলো বুঝতে পারি। তিনি এভাবে বললেন, ” খন্দকার সাহেব আপনি জানেন, বঙ্গবন্ধু আমাকে বাউফলের এম পি মনোনয়ন দিয়ে দিয়েছেন, সে আমার ক্লাসমেট ছিলো, আমার জন্যই মনোনয়ন পত্র জমার, সময় বাড়ানো হযেছে, আমি নির্বাচনে নেমে গিয়েছি, আপনি প্রচারে আসবেন “!। উনি চলে যাওয়ার পর আব্বা রিক্সাওয়ালাকে বললো বাসায় যাও। আজ বাজারে যাবো না। বাসায় এসে ঐ দিন বিকেলের লঞ্চে আব্বা ঢাকা গেলেন। পরদিন সকালে আব্বা ঝিকাতলায় জনাব তাজউদ্দিন সাহেবের বাসায় যান। আব্বাকে দেখে তিনি ক্ষেপে গেলেন এবং বললেন নির্বাচন সামনে, তিনি ঢাকায় কেন?।
আব্বা বাউফলের ফোরকান সাহেবের প্রসঙ্গ তুলে বললেন, বঙ্গবন্ধু নাকি ফোরকান সাহেব কে নমিমেশন দিয়ে দিয়েছেন। তখন তিনি বললেন, নমিনেশন বঙ্গবন্ধু দেন না, তাজউদ্দিন দেয়। তিনি আরো বললেন আপনি বঙ্গবন্ধুর কাছে যেয়েন না, তিনি দেখলে রাগ করতে পারেন। আব্বা ঐদিনই বিকেলের লঞ্চে পটুয়াখালী চলে আসেন। ২ দিন পর নমিনেশন ঘোষণা হয় এবং বাউফলে অব্বাকেই মনোনয়ন দেয়া হয়। তারপর নির্বাচনী প্রচারণা পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। নির্বাচনের মাত্র ৭/৮ দিন বাকি,ঐ সময় বাউফলে ন্যাপের প্রার্থী ছিলেন সৈয়দ আশরাফ হোসন। যিনি ন্যাপের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ছিলেন এবং একজন প্রখ্যাত নেতাও ছিলেন। তার সমর্থনে ওই সময় বাউফলের বগা বন্দরে, একটি বিরাট নির্বাচনী জনসভা হয়, যেখানে বক্তব্য রাখেন ঐ সময়ের এক জাদরেল কেন্দ্রীয় ন্যাপ নেতা। বাউফল একদিকে ন্যাপ অধ্যশিত এলাকা এবং যিনি বক্তব্য রেখেছেন, তিনিও একজন প্রখ্যাত বক্তা। আব্বা কিছুটা ভয়ই পেলেন। তিনি পটুয়াখালী এসে, সবার সাথে আলাপ করে, পরদিন বঙ্গবন্ধুকে বাউফলে আনার জন্য ঢাকা গেলেন এবং সরাসরি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। আব্বাকে দেখে, বঙ্গবন্ধু ভীষণ ক্ষেপে গেলেন এবং বললেন তুমি এসময় ঢাকায় কেন ?। আব্বা বললেন, বাউফলে ন্যাপের একজন বড় নেতা বিরাট মিটিং করেছে, আপনাকেও একবার বাউফল যেতে হবে। তিনি বললেন, নির্বাচনী সভার সব শেডিউল হয়ে গেছে, তিনি যেতে পারবেন না। আব্বা বার বার অনুরোধ করেই যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু এক পর্যায় বললেন, তোমার জন্য, তার ক্লাসমেট কে নমিনেশন দিতে পারেননি, আবার আমাকে নেয়ার জন্য বিরক্ত করছো। ঐ সময় আসলেই তার যাওয়ার কোনো সময় নেই। আব্বা তারপরও নেয়ার জন্য বলেই যাচ্ছেন। এক পর্যায় বঙ্গবন্ধু বলে বসলেন, তোমাকে দল থেকে বাদ দিয়ে দেবো !। আব্বা মন খারাপ করে, বলে বসলেন, “দেন বাদ দিয়ে, আপনার আওয়ামী লীগ আমাকে খাওয়ায় না “। একথা বলে আব্বা ৩২ নম্বর থেকে বেড় হয়ে গেলেন। তখন কেদ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা, মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী, আব্বাকে এসে বাড়ির বাহিরে থামলেন এবং বললেন, বঙ্গবন্ধুর মুখের উপর এভাবে কেউ বলে না, আপনি বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমা চেয়ে যান। আব্বা আর পেছনে ফিরলেন না এবং বিকেলের লঞ্চে পটুয়াখালী চলে গেলেন। পরের অংশ বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ, এক সময়ের ধানমন্ডি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি,কলাবাগানের ফজলুর রহমান রাজু ভাইয়ের কাছ থেকে এবং জনাব তাজউদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে শোনা। (ক্রমশঃ) এডভোকেট খোন্দকার শামসুল হক রেজা, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কৃষক লীগ। ২৭ জুন’ ২০২১।