মোঃ ইব্রাহিম হোসেনঃ আমার একটা পুরনো রেডিও ছিল সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মত সেটা চালু করলাম। সকালের সংবাদ শোনা, গান শুনা আমার অভ্যাস। রেডিওটা অন করার পর ঢাকা সেন্টারে কোন শব্দ হচ্ছিল না শুধু শো শো আওয়াজ। মনে হলো রেডিওটা বোধ হয় নষ্ট হয়েছে; পরে মনে হলো হয়ত ব্যাটারী ডাউন হয়ে গিয়েছে। তাই রেডিওর ব্যাটারীগুলি খুলে ফেলে দিলাম। সকালের খবর আর গান শোনা হলো না। অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম এবং আসাদগেট থেকে বাসে উঠে বসলাম। গণভবনের সামনে যেতেই দেখি নাইন ডিভিশনের সৈনিকেরা এলএমজি মেশিন গান নিয়ে উত্তর দিকে তাক করে বসে আছে। বাসটা তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। মিরপুর এক নম্বরে আমার অফিস জনতা ব্যাংক সেখানে নেমে পড়লাম। অফিসে ঢুকে কাজ শুরু করলাম। সেদিন ব্যাংকে গ্রাহকের সংখ্যা ছিল খুব কম। কিছু সচেতন গ্রাহক ব্যাংকে আসা-যাওয়া করছে। তাদের কাছ থেকে প্রথমে জানতে পারলাম রাতে ‘ক্যু’ হয়েছে। আমার এক সহকর্মী জানতেন, আমি বাংলাদেশ মুজিব নগর সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নিকট আত্মীয়। তিনি আমার কাছে এসে ফিস্ ফিস্ করে বললেন ক্যু সম্বন্ধে কিছু জানি কিনা আরো বললেন রাতে জেলখানায় পাগলা ঘন্টি বেজেছে আপনার আত্মীয় তো জেলে একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন।
আমি তখন ব্যাংক থেকে বের হয়ে প্রথমে ধানমন্ডিতে মিসেস সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিনের নিকট যাই। উনাকে আমার উদ্বেগের কথা জানাই এবং বলি জেলখানায় নাকি পালগা ঘন্টি বেজেছে। এ ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন কিনা। তিনি আমাকে কোন তথ্য দিতে পারেননি। সেখান থেকে বের হয়ে জনাব রহমত আলীর বাসায় গেলাম। ভেবেছিলাম উনার কাছ থেকে হয়ত আজকের সঠিক তথ্য জানা যাবে, কোথায় কি ঘটেছে? বাসায় ঢুকে, তিনি কোথায় জিঞ্জেস করলাম। বাসা থেকে আমাকে জানালেন তিনি মাহবুব আলাম চাষীর বাসায় গিয়েছেন। উনাকে না পেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেটের সামনে দেখি আমার এক বন্ধু মিজান মোটর সাইকেল নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তাকে বললাম, তিনি বাসায় নেই। তখন মিজানকে নিয়ে জেলখানায় গেলাম। জেলখানার ডাঃ মাইনউদ্দিন আমার পরিচিত ছিল। জেলখানার পাশেই তাহার কোয়াটার। আমি আগেও কায়েকবার তার বাসায় গিয়েছি। তিনি আমাকে আত্মীয়ের মত আপ্যায়ন করতেন। জেলখানায় কি ঘটেছে হয়ত তার নিকট থেকে জানা যাবে। বাসায় যেয়ে উনাকে পাওয়া যায়নি। তিনি বাইরে দোকানে গিয়েছেন। তাহার জন্য ড্রইং রুমে বসে অপেক্ষা করতে থাকি। তিনি অনেকক্ষন পরে এসে সোজা বাসায় ভিতরে চলে গেলেন। মনে হল আমাদেরকে তিনি চেনেন না। কিছুক্ষন বসে থাকার পর খবর পাঠালাম তারপর তিনি এলেন। জিজ্ঞেস করলাম জেলখানায় কেন পাগলা ঘন্টি বেজেছে। তিনি বললেন আমিও শুনেছি। তারপর বললাম, আপনি আজকে কি ছুটিতে? তিনি বললেন “না জেল খানায় গিয়েছিলাম” কিছুক্ষণ থেকে চলে এসেছি। আমি বললাম জেলখানায় কি ঘটেছে আমাদের একটু বলেন শুনেছি গুলি হয়েছে। তিনি বললেন আমিও শুনেছি এই বলে চলে যেতে উদ্যত হলেন। আমরাও উঠে পড়লাম। তার এরকম আচরণে আমি অত্যন্ত মনক্ষুন্ন হলাম। যাবার সময় তিনি বলে গেলেন, কিছু একটা ঘটেছে পরে জানতে পারবেন। তারপর মিজানকে নিয়ে ৭৫১ নং ধানমন্ডি তাজউদ্দিন আহমদ সাহেবের বাসায় যাই। তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বাসার সামনে লোকজনের ভীড়। ততক্ষনে খবর হয়ে গিয়েছে যে, জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
এ খবরটি ছড়িয়ে পড়ায় বাসায় বহু লোক জড়ো হয়। ভীড়ের মধ্যে কে যেন বলল, জেলখানায় কোন আত্মীয় গেলে লাশ আনা যাবে। শুনেই আমি সেই লোকের কাছে গিয়ে বললাম, আমি আবু সাঈদ তাজউদ্দিন আহমদের ভাগ্নে। তিনি পরিচয় দিলেন, আমি মোহাম্মদপুর থানার ওসি। তিনি সিভিল পোশাকে ছিলেন। তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে জেলখানায় রওয়ানা দিলেন। নাজিমউদ্দিন রোডে জেলখানার গেটে আমাকে পৌছে দিয়ে ওসি সাহেব চলে গেলেন। আমি জেলের ভিতরে প্রবেশ করে গেটের সামনেই ড্রেনের পাশে চারটি কাঠের বাক্স সাজানো দেখতে পেলাম। আমি সামনের দিকে জেলার সাহেবের অফিসের দিকে গেলাম। সেখানে যেয়ে ঢাকা সদর নর্থের একজন ম্যাজিষ্ট্রেটকে দেখতে পাই। আমি তাকে আমার পরিচয় দিলাম এবং বললাম, বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমদের লাশ নিতে এসেছি। তিনি আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। তিনি আমাকে একটা রুমে নিয়ে গেলেন সেখানে ডিআইজি প্রিজনও আইজি সহ বিভিন্ন স্তরের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ ছিলেন। তাঁরা বঙ্গভবনে ফোন করে বলছেন, তাজউদ্দিন আহমদ স্যারের লাশ নিতে তাঁর আত্মীয় এসেছে। আমাকে লাশ গ্রহণ করার জন্য একটি লিখিত আবেদনপত্র দিতে বললেন। আমি একটি আবেদনপত্রে লাশ হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ করি। তারা আমাকে লাশ কোথায় দাফন হবে সেটা আবেদনপত্রে উলেখ করতে বললেন। আমি বললাম, লাশ আগে হস্তান্তর করুন তারপরে সিদ্ধান্ত নিব কোথায় দাফন হবে। তাঁরা বললেন, যদি কাপাসিয়ায় গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান তাহলে আমরা হেলিকপ্টার দিয়ে পাঠিয়ে দিব। আমি পুনরায় বললাম আগে লাশ হস্তান্তর করুন তারপর কোথায় দাফন করবো পরে সিদ্ধান্ত নিব। হেলিকপ্টারের প্রয়োজন নেই।
শহীদ কামরুজ্জামানের ভাই ইতি সাহেব লাশ আনতে গিয়েছিলেন। তিনি হেলিকপ্টার দিয়ে লাশ গ্রামের বাড়ীতে নেয়ার প্রস্তাবে রাজী হওয়ায় শহীদ কামরুজ্জামানের লাশ হেলিকপ্টারে করে রাজশাহীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
তারা আমাকে অনেক বার বলেছে আপনি চলে যান লাশ আমরা পাঠিয়ে দিব। আমি মনে মনে বলেছি, স্বাধীনতার এই মহান নেতার লাশ জেলখানার ড্রেনের কাছে রেখে আমি বাসায় যাব না। সময় যতই যাচ্ছে রাত ততই গভীর হচ্ছে। পুলিশের আইজি, ডিআইজি প্রিজন কিছুক্ষণ পরপর কোথায় শুধু ফোন করে যাচ্ছে। আমি নাছোড়বান্দা লাশ না নিয়ে আমি বাসায় ফিরব না। আমি বসে মনে মনে ভাবছি, যে মানুষটি দীর্ঘ নয় মাস বিদেশের মাটিতে আত্মগোপন করে থেকে বাংলার দামাল ছেলেদের স্বাধীনতার যুদ্ধে রসদ যোগিয়েছে, প্রেরণা দিয়েছে, সারা দুনিয়ায় দূত পাঠিয়ে বাংলাদেশ ও সরকারকে স্বীকৃতির আহ্বান জানিয়েছে। পাকিস্তানের অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত তিরানব্বই হাজার সৈন্যকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করে এই ভূখন্ডকে স্বাধীন করেছে, সমস্ত লোভ লালসার উর্দ্ধে উঠে ক্ষমতার মোহত্যাগ করে, মন্ত্রিসভার সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেছে, তাকে কোন অপরাধে রাতের অন্ধকারে জেলখানায় হত্যা করা হয়েছে। যে জায়গাটিকে তিনি সবসময় বলতেন, সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হলো জেলখানা, আর সেখানেই তাকে জীবন দিতে হলো ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে।
জেলখানায় বসে মনে পড়লো তখন তিনি প্রধনামন্ত্রী, ছাত্রনেতা শাহজাহান সিরাজ সাহেব বাসায় এসে বললেন লিডার কাদের সিদ্দিকী রাজাকার ধরে স্টেডিয়ামে এনেছে প্রকাশ্যে গুলি করে মারবে। তখনই তিনি বলে দিলেন যাও কাদের সিদ্দিকীকে যেয়ে বলো আইন নিজের হাতে যেন তুলে না নেয়। তাদেরকে জেলখানায় পাঠাতে বল। আইন অনুযায়ী বিচার হবে।
শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে আপন ভাইয়ের চেয়েও আপন মনে করতেন, যার বিপদে-আপদে আন্দোলনে সংগ্রামে সবসময় পাশে থাকিতেন, সেই বঙ্গবন্ধুর পাশ থেকে তাজউদ্দিনকে সরিয়ে দিয়ে ১৫ই আগষ্ট’৭৫ স্ব-পরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, যে মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর বিরোধীতা করেছে তার সরকারের বিরোধীতা করেছে সেই কুখ্যাত মীরজাফর মোশতাকের নির্দেশে জেলখানায় আজকে এই নারকীয় হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে।
গভীর রাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে আমাকে শহীদ তাজউদ্দিন আহমদের লাশ হস্তান্তর করা হবে। তারা জানতে চাইলেন লাশ কি ভাবে নিবেন গাড়ী আছে কিনা। আমি তখন গাড়ীর খোঁজে জেলখানা হইতে বের হয়ে গেটে আসছি। তখন বি,ডি আর-এর একজন মেজর আমার কাছে এসে বললেন আমাকে চিনতে পেরেছেন, আমি মাথা নেড়ে না বললাম। তিনি আমাকে পরিচয় দিয়ে বললেন আমি আতাউর আজ সকালে জেলখানার বাইরে আমাকে ডিউটি দিয়েছে। আমি তখন চিনতে পেরেছি তিনি আমার আত্মীয়। আমি জানতে চাহিলাম লাশ নিয়ে বাসায় নিরাপদে পৌছাতে পারিব কি না। আশংকা ছিল যদি লাশ রিসিভ করিলে পরে আবার ছিনিয়ে নেয়। মেজর সাহেব আশ্বস্ত করিলেন পথে কিছু হবে না। গেটে কাপাসিয়ার আরো দুই জনের সাথে দেখা হল জনাব ফজলুর রহমান ও খালেদ খুররম তাদেরকে আমার সাথে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করিলাম। গভীর রাত বাইরে নীরব, নিস্তব্ধ, নিঝুম অন্ধকার কোথাও কোন আলো নেই, মনে হয় গোটা শহরে নি¯প্রদীপ মহড়া হচ্ছে। তারপর জেলখানার ভেতর যেয়ে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বঙ্গতাজের নিথর লাশটি একটি ট্রাকে নিয়ে রওয়ানা হলাম বাসার উদ্দেশ্যে। সে সময় অপর জাতীয় তিন নেতার লাশ জেলখানার ভিতরেই ছিল। সেই অন্ধকার রাতের ঢাকার রাস্তায় ছিল না কোন জনমানব, ছিল না কোন যানবাহন চারদিকে এক অজানা আতংক বিরাজ করছিল। ট্রাকে সে সময় আমার সাথে ছিল ৩/৪ জন পুলিশ কনস্টেবল এবং ফজলুর রহমান ও খালেদ খুররম। জনাব খালেদ খুররম নিউমার্কেটের কাছে এসে ট্রাক থেকে নেমে সূর্যসেন হলের দিকে চলে গেলেন। অপর জন্য সাইন্স ল্যাবরেটরীর কাছে নেমে ভূতের গলিতে তার আত্মীয়ের বাসার দিকে চলে গেলেন।
৭৫১, ধানমন্ডি বাসায় বঙ্গতাজের লাশ নিয়ে এসে দেখি কোন লোকজনের সাড়া নেই। লাশটি আনতে জেলখানায় যাওয়ার সময় বাসায় শত শত লোক দেখে গিয়েছিলাম, এখন একটি লোকও নেই। অনেক খোঁজাখুজির পর বাসার কেয়ার টেকারকে পেলাম ও তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলাম আমি জেল খানায় চলে যাবার পর রটানো হয়েছিল, যে বাসায় যে কোন মূহুর্তে আক্রমন হতে পারে তাই সব লোক ভয়ে চলে গিয়েছিল। কেয়ার টেকারও লুকিয়ে ছিল। বঙ্গতাজের নিথর লাশের কফিনটি কেয়ার টেকার ও ট্রাক ড্রাইভারের সহায়তায় আমি বাসার ভিতরে নিয়ে যাই। তারপর সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন-কে খুঁজে বের করে খবর দেই। তিনি এসে লাশ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং শোকে পাথর হয়ে যান তারপর নিরাপত্তার জন্য পূর্বের স্থানে দিয়ে আসি।
আমি কফিন এর পাশে একা বসে ছিলাম। কেয়ার টেকার আব্দুল হাই এর বাবা গেটে পাহাড়া দিচ্ছিল। কিছুক্ষন পর সাবেক এর্টনি জেনারেল ফকির সাহাবুদ্দিন সাহেব ও জনাব রহমত আলী আসেন। তারা শোকে মুহ্যমান যাবার সময় বলে গেলেন সাঈদ তুমি একা আছ? আমরা বরফ ও চা পাতা পাঠিয়ে দিব। সে সময় একা একা কফিনের পাশে থেকে ভাবছিলাম যদি আজ তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জেলখানা থেকে ফিরে আসতেন তাহলে আমি এত কাছে যাওয়ার সুযোগ পেতাম না ইত্যাদি নানা কথা। এক সময় মসজিদের আযান শোনা গেল ধীরে ধীরে দীর্ঘ রাতের আধাঁর কেটে গেল। রাতেই রেডিওতে খবর হয়েছিল যে জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় হত্যা করা হয়েছে। সকালে বাসার আশে পাশের লোক জন খবর জানতে বাসায় আসতে শুরু করল। সমাজের সর্বস্তরের লোকজন লাইন দিয়ে তাদের প্রিয় নেতা, দূর্দিনের বন্ধু যে দিন বাংলার ঘরে ঘরে হানাদার বাহিনীর দেয়া আগুন দাউ দাউ করে জ্বলত, সেই দিন তিনি মুক্তির আলোক বর্তিকা নিয়ে বাঙ্গালির মুক্তির জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন, সফল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন, ৭ কোটি বাঙ্গালিকে মুক্ত করে, ভারত, ভূটানের স্বীকৃতি লাভ করে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের স্থান করে দিয়েছিলেন বাঙ্গালী জাতিকে পশ্চিমা হায়নাদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন যার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল যিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জনতা ভীড় করছিল। এই ভীড়ের মাঝে বঙ্গতাজের প্রিয় বন্ধু, একান্ত আপনজন ডাঃ করিম সাহেব কফিন খুলে দেখে চিৎকার দিয়ে কেঁদে ফেললেন। আমার আম্মা সুফিয়া খাতুন যিনি বঙ্গতাজের বড় বোন, ছোট ভাইয়ের লাশ দেখে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
আস্তে আস্তে বেলা বাড়তে থাকলে লাশ দাফনের কথা উঠলে বঙ্গতাজের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী শহীদ ময়েজ উদ্দিন এসে বলে গেলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কবর খোড়া হচ্ছে সেখানেই জানাযা ও দাফন কার্য সম্পন্ন হবে। সাড়ে দশটার দিকে জানতে পারলাম সেখানে আর্মি কবর খুড়ঁতে বাঁধা দিচ্ছে। কিছুক্ষন পর তৎকালীন স্পিকার জনাব মালেক ঊকিল সহ কিছু নেতৃবৃন্দ বঙ্গতাজকে দেখতে এসেছিলেন। সেই সময় জানতে পারলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জানাযা ও দাফন হবে না। তিনি সেখান থেকে শহীদ মনসুর আলীর বাসায় গেলেন সঙ্গে আমিও ছিলাম। তিনি সেখানে গিয়ে জাতীয় নেতাদের লাশ দাফনের ব্যাপারে বঙ্গভবনে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফকে ফোন করলেন। ফোনে তিনি বলেন আমি স্পিকার মালেক উকিল বলছি, আমি তোমার কাছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটু মাটি চাই তাঁর জন্য যিনি এই দেশটিকে স্বাধীন করেছেন সেই তাজউদ্দিনের জন্য। অপর প্রান্ত থেকে ফোন নম্বর চাওয়া হলো, কিছুক্ষন পর জানাবে বলে। ফোন নম্বর দেয়া হলো আমরা সবাই অপেক্ষায় ছিলাম কখন বঙ্গভবন থেকে অনুমতি পাওয়া যাবে? বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করে আমি চলে আসি ৭৫১, ধানমন্ডি বঙ্গতাজের বাসায়। এসে দেখি একটি ট্রাকের উপর কতজন সশস্ত্র পুলিশ। পাশে একটি পুলিশের গাড়ী ও ওয়ার্লেস সহ একটি আর্মির জীপ। ট্রাকটি গেটের ভেতর ঢুকছে। বাসার সম্মুখে যে লোকজনের জামায়েত ছিল আর্মি এবং পুলিশ তাদের সরিয়ে দিয়েছে। আমি বাসায় ট্রাক ঢুকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম কেন এসেছেন। একজন পুলিশ অফিসার উত্তরে বলল লাশ নিতে এসেছি। আমি বললাম লাশ আমি জেলখানার অনুমতিক্রমে এনেছি আপনারা নিবেন কেন। তারা বলল বঙ্গতাজের লাশ বনানীতে দাফন করা হবে আমি তাদের অপেক্ষা করতে বলি। তখন আমি দোতলায় ছুটে যাই জোহরা তাজউদ্দিনের নিকটে বলি পুলিশ বঙ্গতাজের লাশের কফিন নিয়ে যেতে এসেছে, কি করব? তিনি নির্বাক নিস্তব্ধ কোন কথার জবাব দিলেন না। আমি দৌড়ে নিচে নেমে এসে পুলিশের ট্রাকের সামনে দাঁড়াই ততক্ষনে কফিন ট্রাকে তুলে নিয়েছে। আমি বললাম গতকাল জেলখানার অনুমতি নিয়ে আমি লাশ এনেছি জানাযা না পড়ে আমি লাশ দিব না। আমাকে তারা বলিল বড় অফিসারের সাথে কথা বলুন। আমাকে দেখিয়ে দিল ঐ যে রাস্তার উপর গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। আমি গিয়ে দেখি ডিআইজি সাহেব আমি তাকে বললাম গতকাল রাতে বঙ্গভবনের অনুমতি নিয়ে জেলখানা থেকে লাশ আমি এনেছি এখন জানাযা না পড়ে লাশ আমি দিব না। স্পিকার মালেক উকিল বঙ্গভবনে কথা বলেছেন, খালেদ মোশাররফের সাথে জানাযা ও কবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হবে। এ কথা বলার পর আর্মির গাড়ী এবং তিনি একটু সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওয়ার্লেসের মাধ্যমে বঙ্গভবনে যোগাযোগ করছিলেন। তৎক্ষনাৎ আমি ট্রাকের কাছে গিয়ে কফিনটি নামিয়ে দিতে বলি, এখানে জানাযা পড়িব। লাশের কফিন ধরে টানতে থাকি। এমতাবস্থায় পুলিশও আমাকে একটু সাহায্য করল। বাসার সামনে আম গাছের নীচে কফিন রেখে লোকজন ডাকতে শুরু করি। আপনারা আসুন এখানেই জানাযা হবে। ওয়ার্লেস সহ আর্মির সশস্ত্র গাড়ী দেখে লোকজন ভয়ে রাস্তার ঐপাড়ে দূরে দাঁড়িয়ে আমার কর্মকান্ড দেখছিল। আমার ডাকে তারা এগিয়ে আসল এবং তাদেরকে কাতার ধরে দাঁড়াতে বলি। আশে-পাশের বহুলোক মুহুর্তের মধ্যে কাতার বন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ঈদগাহ মসজিদের ইমাম সাহেবকে জানাযা পড়তে বলেছিলাম। তারা সকাল থেকেই লাশের পাশে কোরআন তেলাওয়াত করছিল। পরে বঙ্গতাজের ছোট ভাই জনাব মফিজউদ্দিন আহমদ জানাযার নামাজ পড়ান।
জানাযা শেষ হতেই লাশ ট্রাকে করে বনানী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে লাশের সাথে যারা ছিল তারা ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। সেখানে ৩টি কবর আগেই খোঁড়া ছিল। আমরা যাওয়ার পূর্বেই শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও শহীদ মনসুর আলীর লাশ দাফন হয়ে যায়। পুলিশ আমাকে বলেছিল বনানীতে জানাযা হবে কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম জানাযার কোনপরিবেশ সেখানে নেই। কোন লোক সেখানে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না। কবরস্থানের রাস্তায় আর্মির চেকপোষ্ট বসানো ছিল। আমি মনে মনে এই ভেবে স্বান্ত্বনা পাই যে, আমরা বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমদের জানাযার নামাজ পড়তে পেরেছি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত যারা সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে তাদের অনেকেরই জানাযার নামাজ হয়নি।
আমার এই ছোট্ট ঘটনাটা হয়ত অনেকের কাছে গুরুত্বহীন মনে হবে। ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ এর প্রেক্ষাপটে যারা সেদিন ঢাকায় ছিলেন শুধু তারাই হয়ত এর মমার্থ কিছুটা অনুধাবন করতে পারবেন। ২৭ বছরের এক যুবক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মনের অপরিসীম সাহস নিয়ে বন্দুকের সামনে থেকে শহীদ বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমদের লাশ নিয়ে জানাযার নামাজ পড়ানো যে কতটুকু দুসাধ্য কঠিন ছিল তা হয়ত আজ এই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অনুকূলে পরিবেশে বসে আজ থেকে ৩৫ বৎসর আগের ঘটনা এই মুহুর্তে কেহ অনুধাবন করতে পারবেন না। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। সেই সাথে এই নারকীয় হত্যাকান্ডের পুণঃবিচার দাবী করছি। সাথে সাথে এই মহান নেতার নামে গাজীপুর জেলার নাম তাজউদ্দিন নগর করার দাবী করছি।
লেখকঃ বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ভাগ্নে ও জেলহত্যা মামলার অন্যতম স্বাক্ষী এবং রাজধানী মোহাম্মদপুর থানার ৩১ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ তালুকদার।