জনাব রবিউল আলমঃ মুক্তির বার্তা নিয়ে ডিসেম্বর আমাদের মাঝে। স্বাধীনতা মানচিত্র, শ্রত্রু মুক্ত আভাশভুমি, মুক্ত আকাশ, বাতাশ নিঃস্বাস। মনের আনন্দের মাঝে বেদনার ছায়া। ধ্বংসকুব পোড়াভুমি, আগুনের লেলিহান,আপনজন হারাদের গগনবিদারীত কান্নার মাঝে বিজয়ের শ্লোগান শুনেছি এই ডিসেম্বরে। ডিসেম্বর শুরুটাই ছিলো, হয় বাচো না হয় মরো। রাইফেল, টমিগান, স্টেনগান, বাশের লাঠি, বিমান হামলার মাধ্যমে, বাংলার নারী পুরুষ, কিশোর কিশোরী বয়োবৃদ্ধদের বাধাহীন, বাধভাঙ্গা আক্রমনে হানাদার বাহিনী ৮ ডিসেম্বর সান্দ্য আইন জারী করলেন, দেখামাত্র গুলি। ঘর বন্দী, শব্দ বন্দী জীবন।
রায়ের বাজার বদ্ধভুমির পাশেই আমাদের বাড়ী, বর্তমান হোসেন সাহেবের গলি, দেবরাজ মুহুরীর বাড়ীতে। দর্জার ফুটো দিয়ে ঋষিপাড়া ও রাস্তা দেখা যায়। পেছনে খালের পার থেকে বধ্যভুমি ও নির্যাতনের জন্য চিহ্নিত বটগাছের দুরত্ব ১০০ হাত। রাতের নির্যাতিতদের চিৎকারে হৃদয় কেপে উঠে। সে রাতেই ঘরের দর্জায় পাকিস্তান হানাদারের যৌথ বাহিনীর আগমন। সাথে থাকা রাজাকাররা এলাকার পরিচিত মুখ, লালু, দারোগালি, উজিরা সহ অনেকেই ছিলো। বাবা দর্জা খোলার সাথে সাথে বন্দুক ঠেকিয়ে ঘরের সামনে মাটির টেকের উপর নিয়ে দ্বার করালো। মা আমার হাতটা শক্ত করে দরে আছে, আমি ছোটার চেষ্টা করছি, বাবার কাছে যাবো বলে। এক সময় মায়ের হাতটা নরম হয়ে আসায়, এক দৌড়ে বাবার হাতটা আমিও শক্ত করে দরে রাখলাম। বাবাকে যৌথ বাহিনীর কমাণ্ডার দেখে অভাগ।একজন আর একজনকে প্রশ্ন করছে, এ কেয়ছা মালাউন ? এতনা বারা নুর মালাউনকু নেহিহোছাক্তা। বাবার মুখের দাঁড়ী অনেক লম্বা ও বড় ছিলো। কমাণ্ডার বাবার কাছে জান্তে চাইলো আপ মুসলিম হায়। বাবা ভারতে দীর্ঘকাল অবস্থান করায় উর্দু, হিন্দি সহ অনেক ভাষা জান্তো। বাবা কমাণ্ডারকে সালাম দিয়ে একটি কলেমা পড়ে নিলো। কমাণ্ডার বুঝতে আর অসুবিধা হলো না। রাজাকার যারা সাথে ছিলো হিন্দু বাড়ী বলে চিহ্নিত করেছিল, তাঁদেরকে মারতে মারতে অকত্যভাষায় গালাগাল। প্রকৃত পহ্মে বাড়ীটি হিন্দু বাড়ীই ছিলো।
একমাত্র মুসলমান আমরা। মামা হোসেন সাহেব বাড়ীটা কিনে নেওয়ার জন্যে। পেছনের ঘরে দেবরাজ মুহুরী ও তার নাতি নাতকুরা, পরের ঘরে গোপাল, হরিলাল, নরেশ। সামনের ঘরে কালাচাঁদ, স্যামপাল, স্যামপালের ছেলে গোপাল। বাবা কিছুটা ভয়ে আছে মিথ্যে বলার জন্য। সকালেই রাজাকাররা বাবাকে হেস্তনেস্ত করতে পারে। কমাণ্ডার বাবার কথায়,ভাষায় অনেক খুসী হয়েছে, বুঝতে পারছি। কমাণ্ডার, চাচা আন্ধারমে কইহায়। হায়। কিয়া হায়। হিন্দু, মুসলিম না বলে অনেক বুদ্ধি করে বাবা বললো, কুমার হায়। কুমার কিয়া কারতাহায়। ঘরের সামনে একটা তুন্দুল রুটি বানানোর চুলা ছিলো, কালাচাঁদ তুন্দুল বানাতো। একমুহূর্ত চিন্তা না করে, বাবা তুন্দুল দেখিয়ে দিলো, ইয়াহায়। সেনা বাহিনীর জন্য তুন্দুল, তারপরেও পাকিস্তানি বলে কথা। কমাণ্ডার আবার মুস্কি হাসিতে বাবাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যাওয়ার আগে একটা কার্ড দিয়ে, কৈ আপকো কুসনেহি কহেঙ্গে, হাম ফের আহেঙ্গে তান্দুল লেনেকেলিয়ে। যাওয়ার আগে আমাকে হাত দরে নিয়ে গেলেন, হিন্দু ও পাকিস্তান বিরোধীদের দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। মার চিক্কার, বাবার মলিন মুখ, কাছেই স্যামপাল ও তার ছেলে গোপালকে অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে গাড়ীতে উঠানোর দৃশ্য দেখে আমি বোবা হয়েগেছি। হাটতে, চলতে পারছিনা। অনেক গুলো প্রশ্নের একটা উত্তর ও দিতে পারলামনা।না পারলাম কারো বাড়ী দেখিয়ে দিতে। যৌথবাহিনি দুর্গামন্দীরের গলিতে ডুকতেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিকট আওয়াজে চরমপত্র পাঠের শব্দ। মাউরা হালাগো, মৌলবী বাজারের কসাইরা লাগুর পাইছে, ১০টারে কোপাইছে, একটারে কিমা বানাইয়া বুড়িগঙ্গায় ফালাইছে। মুহুর্তে মধ্যে মরন চাঁদের বাড়ীতে ডুকে, শান্তি কমিটির অফিস সহকারী সাওকায়াত ভাইকে দরে আনলো রেডিও সহ। বার বার বলার চেষ্টা করছে, হাম আপকি আদমি হায়, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হেদায়েত উল্লাহকে ডাকার চেষ্টা হলো। হাসেম চেয়ারম্যানের বাড়ীতে নেওয়ার অনুরোধ করা হলো। কোনো কথা শুনার জন্য প্রস্তুত না কমাণ্ডার। তার একটাই প্রশ্ন তোম হামারা আদমি হোকার স্বাধীন বাংলা শুনতা হায়, মাদারচুদ। রাইফেলের প্রথম বারিতেই জ্ঞান হারায়, ফিমকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া দেখে নিজের অজান্তেই দৌড়। আমার মনে হয়, সাওকায়াত ভাই সেখানেই মৃত্যু বরন করেছে। গাড়ীতে আরো ১০/১২ জন আহত বন্দীদের সাথে তার লাশটা নিয়ে গেলেন। পরে আরো অনেক কেই বন্দী করা হয়েছে। অসমাপ্ত পর্ব (১) দ্বিতীয়। সকালের স্যামপাল ও তার ছেলে গোপালের দেখতে পেলাম, হোটেলে। জান্তে চাইলাম জীবিত আসার অলৌকিক ঘটনা।
রায়ের বাজার, মোহাম্মদপুর বাঙালীর প্রিয় মানুষ জমির সার্জেন্ট এর সামনে পরাতে স্যামপাল আর গোপাল জীবিত আসতে পেরেছে। সাওকাত ভাই জীবিত থাকলে হয়তো আসতে পারতো। সান্দ্য আইনের জন্য কারো বাড়ীতেই খাওয়ার জন্য কিছুই নাই, মার কাছে ভাত চাওয়াতে চোখের পানি দেখতে হলো। মাও কিছু খায় নাই। মনের কষ্টে খালের পারে গিয়ে বসলাম। দুর থেকে সাদেক খান বর্তমান সংসদ সদস্য ও হোসেন সাহেবদের ইটের খোলায় অনেক মানুষ মাছ দরছে, দেখা যায়। ইতিমধ্যে আমার বড় ভাই সফিউল্লাহ মৃত্য, খালু সফিউল্লাহ, তার ভাই চাঁনমিয়া কুয়েতে অবস্থান, পাশে এসে দ্বারিয়েছে। মনে একটু সাহস নিয়ে সবাইকে বললাম চলো মাছ ধরতে যাই, সম্মতি পেয়ে আর দেরি করলামনা। মাছ ধরতে ধরতে কখন যে আমি ইউনুস চেয়ারম্যানের খোলায় চলে গিয়েছিলাম, সাথের সবাইকে ফেলে। যেখানে বুদ্ধিজীবীদের কে হত্যা করা লাশ ফেলে রাখা হয়েছে। কুকুরে খাচ্ছে, কাকে চোখ নিয়ে উড়াল দিচ্ছে। কারো হাত নাই, কারো পা নাই বিভ্রস্য এই দৃশ্য দেখে আতংকে চিক্কার করতে থাকলাম। আমার থেকে অনেকটা দুরে অবস্থান করছে, আমার সাথীরা। ইতিমধ্যে পাহাড়ায় থাকা রাজাকারা ভয়ে গুলি শুরু করে দিয়েছে মুক্তিবাহিনীর আক্রমন মনে করে। ১১ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ঢাকার চারিপাশ ঘেড়াও করে রেখেছে। আমরা চারজনই একসাথে হয়ে ইটা বানানো মাটির পাশে সুয়ে পরলাম। গুলি চলছে অনেক সময়। প্রতি উত্তরে কোনো গুলি না হওয়াতে আস্তে আস্তে রাজাকাররা আমাদের কাছে এসে হ্যানসাপ বলে হাত উঠাতে বললো। আমরা হাত তুলে দিলাম। প্রথমেই আমার খালু সফিউল্লাকে রাইফেলের বাট দিয়ে স্ব জোরে আঘাত করা হলো মুখের উপর, ঠুটের মাংসটা জুলে পরাতে চারখানা দাত দেখা যাচ্ছে। আমার ভাই সফিউল্লাহকে মাথায় আঘাত করা হলো, মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে। চাঁনমিয়াকে ঘারের উপর হাতের অংশে, রাইফেলের বাটের আঘাতে সুয়েপরলো। আমাকে আঘাত করার উদ্যোগ নিতেই চিটাগং এর একজন রাজাকার আমাকে চিনে ফেলে, হাত উচুকরে রাইফেল আটক করে, চিক্কার দিয়ে বলছে, ইস্যকু মাতমারো। এয়ে মাসুম বাচ্চাহায়। বয়স আমার সারে ১৩ হলেও দেখতে ৮ বছরে শিশুই মনে হয়। এখনো দেখলে ৬৩ বছর মানতেই চায় না কেউ।মরার পরে হয়তো বয়সের হিসাব মিলাতে হবে। রায়ের বাজার মাংসের দোকানের উপরে রাজাকার ক্যাম্প। অনেক রাজাকার আমার কাছ থেকে মাংস নিতো। চিটাগংগের রাজাকারটাও এ থেকে আলাদা নয়। সাথে মাছের পাতিল দেখে সবাইকে ছেড়ে দিলো। বাড়ী আসার পথে খালপার হওয়ার সময় খালেক নামের এক রাজাকার উচ্চসুরে ডাক, ইদার আও, এই সালালোক ইদার আও। আতংকিত হয়ে, নির্যাতিত বটগাছের নিচে দ্বারানো রাজাকার খালেকের কাছেই গেলাম। কাছে গিয়ে দেখি আমাদের রিকসা চালাতো খালেক চাচা। বাবার সাথে অনেক ভালো সম্পর্ক ছিলো। আমি অনেক মজা করতাম, আমাকে নিয়েও খালেক অনেক মজা করতেন। পুরনো অভ্যাস থেকেই খালেক কে হালারপুত বলে জিগ্যেস করলাম, বাংলা ভুইলাগেছো নাকি। স্বজোড়ে আমার গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে জমির সার্জেন্টের কাছে নিয়ে গেলো। সার্জেন্ট আমাকে দেখেই চিনতে পারলো, অকর্ত্বভাষায় গালাগাল দিয়ে, নাম ঠিকানা লেখে ছেড়ে দিতে বললো। ইয়ে আদমি মেরা জানপাচানকা হায়, বলে চলে গেলেন। একজন রাজাকার সফি খালুর জুলানো ঠুটে একটু মলম এনে সুপার ভুলুর মত ঠুটটা লাগিয়ে দিলেন,ব্যাথা নিরাময়। আমি পাতিলের মাছের দিকে চেয়ে আছি, চোখে পানি পরছে, পেটের খুধায় অস্তির। ইতিমধ্যে পাকিস্তানি দায়ীত্ব প্রাপ্ত অফিসার এসে হাজির। নাম ঠিকানা লেখার সময়, নোয়াখালীর মানুষ জান্তে পারায়, পাশে থাকা হালকা মেশিগান নিয়ে তেরে উঠলো। গুলি করার পুর্বমুহুর্তে একজন অফিসা জমির সার্জেন্টের কথা মনে করিয়েদিল। অফিসার সার্জেন্টকেও গালাগার দিতে ছাড়লো না। চোখ, হাত বেধে অন্দ্রকার একটি রুমে ফেলে রাখা হলো।
আবদুল হাই কোম্পানির বাড়ীর ক্যাম্পের ছোট্ট একটি রুমে ১৫/২০ জন মানুষকে আলুর বস্তার মত ফেলে রাখা হয়েছে (আনুমানি) একে অন্যের সাথে আলাপ চারিতায় বুঝতে পারলাম সেলিনা পারভিন তখনো জীবিত। কিছু সময় পরে আমাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হলো। কি আলাপ, কি ভুমিকা রেখেছেন জমির সার্জেন্ট আজও জানা হয় নাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাঙালী ফুলের মালা ও ব্যান্ডপার্টি সহ জমির সার্জেন্টকে ঘুরিয়েছে, রায়ের বাজার মোহাম্মদপুরের । বাংলাদেশ সরকার তাকে চাকরিতে পুর্ণবহাল করেছে। চট্রোগ্রামের উচ্চপদে থাকা অবস্থায় মৃত্যু বরন করেন। পর্ব (২) চলবে।
লেখকঃ বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব ও রাজধানী মোহাম্মদপুর থানার ৩৪ নং ওয়ার্ড আওয়ামলী লীগের সভাপতি জনাব রবিউল আলম।