জনাব রবিউল আলমঃ আমরা বিদেশি লাল চামড়া মানুষ গুলোর পেছন পেছন হাটছি। মাঝে মাঝে হাটা থামিয়ে, আমাদের সাথে কথা বলতে চায়, জান্তে চায় কি হয়েছে, কোথায় কোথায় মানুষ হত্যা করেছে। আমি অনুমান করতে পারছি। বুঝতে পারছিনা, বুঝাতেও পারছিলামনা। পরিপূর্ণ ইংরেজি না জানাতে। আমরা হু’হা, ইয়েজ নো করেই চলেছি। এমন সময় একজন সংবাদিক দোভাষীর ভুমিকা এগিয়ে আসলো স্ব উদ্যোগে।আমাকে প্রথম প্রশ্ন করা হলো, রাজাকার ক্যাম্প কোথায় ছিল, বুদ্ধিজীবীদের ও সাধারন মানুষকে কিভাবে, কেমন করে, কোথায় কোথায় হত্যা করা হয়েছে।আমি আস্তে আস্তে আব্দুল হাই কোম্পানির বাড়ীটা ও বটগাছটা দেখিয়ে দিলাম। দোভাষী ইংরেজদেরকে বুঝিয়ে বলছেন। কথা না বলে, আমাকে সাথে নিয়ে রাজাকার ক্যাম্পে হাজির হলেন। আমি ক্যাম্পের বন্দী রুম সহ সব কিছুই দেখিয়ে, বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। দোভাষী বুঝিয়ে বলছেন বিদেশিদের। তারা নোট করছেন, ছবি তুলেছেন। বটগাছের কাছে আসতেই দুর্গন্ধে পেটের নারীভুড়ী বের হয়ে আসার উপক্রম। আমি বিচলিত, বিব্রত হলেও বিদেশিরা একটুও বিব্রত নয়। পকেট থেকে নোমাল বের করে সবাই নাকে বেধে নিলো।আমারতো আর নোমাল নাই। বিদেশি এক মহিলা সাংবাদিক, তার কাছে থাকা গামছার মত একটা কাপর আমার হাতে দিয়ে, ইশারায় মুখে বেধে নিতে বলছেন। আমি তার ইশারা বুঝতে পেরেই বেধে নিতে দেরি করলামনা। বিশাল বটগাছ, পাশেই ঘাট বাধানো বিশাল পুশকুনি। চারিদিক উন্মুক্ত, কোথাও কেউ নাই। বটগাছের পুর্ব দিকে কয়টা বাড়ী থাকলেও মানুষজন নাই। উত্তর-দহ্মিন,পশ্চিম মানুষ ও বৃহ্ম শুন্য। চারিদিকে হাহাকার। আমি বটগাছের ভিতরে ডুকে বিদেশেদের কে বেনেট ও গুলির চিহ্ন গুলো দেখালাম। এখনো গাছের ডালে রশি বাধা আছে, নির্যাতনের চিহ্ন। কোন কোন ডালের সাথে বুদ্ধিজীবীদেরকে জুলানো হয়েছিল। পুকুরের ঘাটে ছেড়া পাটি ও নারী পুরুষের কাপর পরে আছে। ছবি তুলছে, নোট করছে। ঘাটের পারে যেতেই চার-পাচটা লাশ পচে ভেসে উঠছে। কাকে ঠুকরাতে ঠুকরাতে পেট ফুটো করে দেওয়াতেই দুর্গন্ধ ছরিয়ে পরেছে। ছবি তুলার কাজ শেষ হতেই আমরা সেখান থেকে চলে আসি। বটগাছ আর বধ্যভুমি ইতিহাস একি সুত্রে গাথা। একটি বাদ দিয়ে আর একটির পুর্ণতা আসেনা। আজকের মত করে সেদিন ভাবতে পারিনি, বুঝতে পারিনি স্বাধীনতার অর্থ। হারানো আপনজনের বেদনা, মনের শুন্যতা চোখের বেকুলতা থেকেই নিজেকে সফেছিলাম মানব সেবায়। ইতিহাসের সাহ্মী হবো, বুঝতে পারিনি। আজকের লেখা মনের অপুর্ণতা থেকে। বিবেকের তারনায় নাইট স্কুলের সহায়তায় কিছুটা বিদ্যা অর্জন করতে হয়েছে। শত অভাবের মাঝেও যাতে কর্ম জীবনের ব্যাঘাত না ঘটে। বুদ্ধিজীবীদের ফেলে রাখা লাশের কাছাকাছি গিয়ে ঘাসের উপর বসলাম। ৮ ই ডিসেম্বর থেকে ঘটে যাওয়া আমার দেখা দুর্ঘটনা একের পর এক বলে চলেছি। দোভাষী নিজেও লিখছেন, বিদেশিদেরকে লিখতে সহায়তা করছেন। আজ ১৮ ডিসেম্বর কেউ আমাদেরকে লাশ তুলে দেওয়ার জন্য সহায়তা চায় না। অনেক সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের আগমন। যে যার ইচ্ছেমতো ভুলভাল তথ্য দিয়ে চলেছে। প্রকৃত, প্রতহ্ম দশী একমাত্র আমিই রায়ের বাজার বদ্ধভুমি থেকে জীবিত ফেরত এসেছিলাম এবং এখনো বেচে আছি। আমার আগে ১১ ডিসেম্বর কেউ জান্তেই পারেনি, এখানে বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করা হয়েছে, লাশ ফেলে রাখা হয়েছে। আব্দুল হাই কোম্পানির বাড়ীতে রাজাকার ক্যাম্প ও ফিজিক্যাল কলেজে আলবদর, আলসাম বাহিনীর ক্যাম্প থেকে রাতের আধারে নিঃসংশ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। দোভাষীর প্রশ্নে চৈতন্য ফিরে পেলাম। ইটের খোলা থেকে পশ্চিম পাশে খাল, সেদিকেই চলেছি। আমি নিজেও অভাগ হলাম। এ পর্যন্ত আমিও পশ্চিম পাশে আসিনি। বড় বড় গর্থ করে ১০/১২ জনের লাশ মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। লাশ ফুলে উঠায়, মাটি সরে যাওয়াতে কুকুরে লাশ নিয়ে টানাটানি করছে। শকুন আর কাক মাঝে মাঝে আসে। চলবে এগারোতম ১১ পর্ব নিয়ে আসবো।
লেখকঃ বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব ও রাজধানী মোহাম্মদপুর থানার ৩৪ নং ওয়ার্ড আওয়ামলী লীগের সভাপতি জনাব রবিউল আলম।