জনাব রবিউল আলমঃ রাত যত বারছে, সাধাবন মানুষে আওয়াজ ততোই কমে আসছে। নির্যাতিতদের চিক্কারে আওয়াজ বিকট হচ্ছে,হত্যার তালিকা লম্বা হচ্ছে মনে হয়। রাস্তায় গাড়ীর সংখ্যাও বেশী। সেনাবাহিনীর গাড়ীগুলোর আওয়াজ নাই বলতে পারেন। একেবার চোখের সামনে আসলেই বুঝতে পারি দর্জার ফুটো দিয়ে দেখার জন্য। বন্দী বহনকারী গাড়ী অনেক দুর থেকেই বুঝা যাচ্ছে, সংখ্যায় ও বেশী। কি হচ্ছে চারিদিকে। মা-বাবা বুঝতে পেরেছিলেন কি না, জানিনা। আমার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না, অগুনিত মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। ১৪ ডিসেম্বর ঘুম ভাংতেই মনের অস্তিরতা বেরে গেলো। রাস্তায় কোন গাড়ী নাই, নাই কোনো লোকজন। সারারাতের ভয়ে কোন আওয়াজ করছে না, কোন বাড়ী থেকে। বাবা ঠিক করলেন এই বাড়ীতে আর থাকা যাবে না, অনেক কিছুও নেওয়া যাবে না। মাকে বলা হলো দুই চারটা খেতা, বালিশ ও থালা বাটি পাতিল নিয়ে নেও। সব বাধা হলো। বাড়ীতে থাকা হরিলালের মা দেখে ফেলাতেই বিপ্তি বাধলো। মায়ে হাত দরে কান্না শুরু করে দিলো, বাড়ীর সবাই এসে হাজির। পাশের বাড়ী থেকে হোসেন সাহেব, তার স্ত্রী ছেলে মেয়েরাও হাজির হলেন। নিরব পরিবেশের বিগ্নঘটলো। আমার মামা হোসেন সাহেবের একটা-ই কথা, এই অবস্থা এতগুলো মানুষ নিয়ে কোথায় যাবে। মরতে হয় এখানেই মরো আমাদের সাথে, দেখ তেতো পারবো কে কে মারা গেলো আর কারা বেচে আছে। প্রয়োজনে রাতে আমার বাড়ীতে থাকবা। আমাদের আর স্থান পরিবর্তন হলো না। দুইটা থেকে কার্ফিও শীথিল করা হলো। আজ আর আগের মত লোক সমাগম হচ্ছে না রাস্তায়। মানুষের মনে এতটা আতংক সৃষ্টি হয়েছে, জীবনের চেয়ে নিত্যপন্যের প্রয়োজন ছোট হয়ে গেছে। দুই চারজন যাও রাস্তা ও বাজারে এসেছে, দোকানদারেরা একদর্জা একপাট খুলে সদাই দিচ্ছে। দোকানও দুই চারটাই খুলেছে। আমি বাবাকে বলেই রায়ের বাজার, বাজারে চলে এলাম। মাকে বলাম রাতে বাড়ী নাও আসতে পারি। বাজারে এসেই মহাজনের করুন অবস্থা চোখে পরলো। একটি গরু জবাই করা হয়েছে রাজাকারদের হুকুমে। একা কিছুই করতে পারছেনা। আমাকে দেখেই আলোকিত হলো, সহায়তা করার জন্য অসহায়ের মত চেয়ে আছে হাবিবুল্লাহ চাচা। রাজাকাররা দ্বারিয়ে আছে মাংস নেওয়ার জন্য। সবাইকে মাংস দিয়ে কিছুটা মাংস আমি ও চাচা নিয়ে নিলাম। ইতিমধ্যে কার্ফিও শুরু হয়ে গেছে। বাড়ী যাওয়ার জন্য রাজাকারদের সহায়তা চাইলাম। রাজাকার ক্যাম্পের পাশের রুমের ছুঁড়ি চাকু রেখে, তাদের সহায়তায় আমি ও চাচা যার যার বাড়ীতে পৌঁছাতে সফল হলাম। রাতে হোসেন সাহেবের বাড়ীতে থাকায় কান্নাকাটি ও রাস্তায় সেনাবাহিনীর গাড়ীর আওয়াজ পাচ্ছিলামনা। সবাই অনেক শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। আমার ঘুম আসছে না। প্রতিরাতে অভ্যাস ও কৌতূহল নিয়েও ঘুমাতে হতো। এতটা নিরবতা আমাকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। তবে কি রাজাকাররা মানুষ মারা বন্ধ করে দিয়েছে ? আমার সাথে মাংস নেওয়ার সময় কতটা ভালো ব্যবহার করেছে। রাজাকাররা মনে হয় ভালো হয়েগেছে। আমার পৃথিবী তখন রায়ের বাজার নিয়েই, এভাবেই রাত্রী পার করতে হলো। নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পরেছিলাম। ১৫ ডিসেম্বর ঘুম থেকে উঠেই নিজের ঘরে গিয়ে চিরাচরিত সেই দর্জার ফুটোতে চোখ রাখলাম। অনেক অপেহ্মার পরেও একটা সেনাবাহিনীর গাড়ী দেখতে পেলামনা। নাই কোনো রাজাকারদের আগমন, হেনতেন কারেঙ্গার আওয়াজ। মনে আরো কৌতুহল বেড়ে যাচ্ছে। মামার বাড়ীতেই নাস্তা খাওয়া হলো গতকাল আনা মাংস ও রুটি দিয়ে। মামা আস্তে আস্তে বাবাকে বলছে পাকিস্তানেরা পলাইতে পারে, দেশ মনে হয় স্বাধীন হইবো, চারিদিক দেখছোনা নিরব হয়ে গেছে। বাবা কিছহটা নরেচরে বসলো। কার্ফিও চলছে,আমি পাবনা হাউজের গলি দিয়ে রাস্তার মুখে চকএলিদের বাড়ীতে এসে দ্বারালাম। ভাবী,বেবীর মা আমাকে দেখেই টানদিয়ে বাড়ীর ভিতরে নিয়ে গেলেন। ভয়ে আতংকিত। আমি ভাবীকে জ্ঞান দান করছি স্বাধীনতার, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পলায়নের, রাজাকাররা আজ রাস্তায় না আসার কারন, বাবা ও মামার আলাপচারিতা থেকে। নিজে কিছুই বুঝতে পারিনাই। তার পরেও জ্ঞানী হওয়ার একটা মনোবাসনা পুরন করা সুযোগটা নিয়ে বেবীর মার ভয় দুর করার কাজে লাগালাম। বেবীর মাও আমাকে অনেক আদর করলেন, কিছু খাবি রবিউল। অন্যদিন হলে””মাংস দিয়ে রুটি, পেটতো””আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। চলবে সষ্ট ৬ পর্ব নিয়ে আসবো।
লেখকঃ বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব ও রাজধানী মোহাম্মদপুর থানার ৩৪ নং ওয়ার্ড আওয়ামলী লীগের সভাপতি জনাব রবিউল আলম।