সাতাশ ২৭ পর্ব
সারাদিন জামালের গণ্ডগোলে মুক্তিযোদ্ধা মাংস ব্যবসায়ী আজমলের সাথে কথা বলা হয় নাই। ইতিমধ্যে আজমলের বাবা মতিন ভুইয়ার দোকানদারী শেষ হয়ে গেছে, জয়নাল-হাবিবউল্লাহ,জামালের ত্রিমুখি গণ্ডগোলে। দুপুরের খাওয়াও হলো না, মাংস বিক্রিও হলো না। কর্মচারীর সংখ্যাও বেশী হওয়াতে আমাকে দুই টাকা দিয়েই বিদায়ী করে দিলো। মাংস নিয়ে সবাই বংশাল চলে গেলো কোন এক যায়গার বিক্রির জন্য। বিকাল হলেই রায়ের বাজারে কোনো লোকজন থাকে না। আমি আর পরদিন কাজে আসলাম না। অনেকদিন বধ্যভুমি ও বটগাছের কাছে যাওয়া হয় নাই। সকালে বাড়ী থাকলেও মাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে, পাঁচ টাকার রোজ দুই টাকা হয়েছে। বিপদের সময় আমি অনেক সহায়তা করেছি, এখন লোকজন বেশী হওয়াতে আমাকে দুই টাকা দেওয়া হলো, দুঃখ ও অভিমান নিয়েই নাস্তা করে নিচে চলে গেলাম। কিছুটা সময় বটগাছের নিচে বসে বধ্যভুমিতে গেলাম। আপন মনেই হেটে চলেছি, কোথাও কেউ নাই। কত না স্মৃতি ভেষে উঠছে মনে। মহাজনের দুই টাকা রোজ, সাংবাদিকদের না আসার ব্যাদনা, বিদেশি সাংবাদিকের এক হাজার টাকা দেওয়া, এই ভুমিতে আমাকে হাত চোখ বেধে ফেলে রাখা, বুদ্ধিজীবীদের অগুনিত লাশ, অবাঙালী ও রাজাকার হত্যা করা। কিছুতেই মনটা কে একি স্থানে রাখতে পারছিনা। পেছন থেকে ডাক শুনেই ফিরে তাকালাম আজমল ভুইয়া, কিবে কামে গেলি না। দুই টাকা রোজের কথা, দুঃখ ও অভিমানের কথা বললাম। আমাকে নিয়ে ঘাসের উপর বসলো। আমি কিছু কথা বলতে চাইলাম, মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চাইলাম। আমাকে থামিয়ে আজমল বললো কালকে সকালে তুই মোহাম্মদপুর টাউন হল আসবি আমার দোকানে, পরে বাকী কথা বলা হবে। দুপুরের ভাত খাওয়ার সময় মা রোজের টাকা চাইলো। মাকে আর কিছু বলা হলো না, হু-হা বলেই শেষ করলাম। মা কখনো আমাকে জোর করত না। আমি কখনো নিজের কাছে টাকা রাখতাম না। বড় ভাই সফিউল্লাহ কে কখনো মা বিশ্বাস করতেন না, সে টাকা এদিক ওদিক করতো। মাইরও বেশী খাইতো। পরেরদিন মোহাম্মদপুরের গিয়ে দেখি বর্তমান শহিদ পার্ক দখল করে বাজার বানানো হয়েছে। মেইন রাস্তার সাথেই দোকান, আজমল, কমলাপুরের বাসের বডি মিস্ত্রি মুক্তিযোদ্ধা জাকির, হাজী নুরুর বোন জামাই মাহতাব চৌধুরী সহ অনেকেই। গরু জবাই করে মাংস বিক্রি শুরু করলাম। ভালোই চলছিলো, হাত খরচের জন্য টাকাও দেওয়া হলো। বাড়ী এসে হাবিবউল্লাহ চাচা খবর পেলাম, বাড়ী এসেছিল। মাকে বললাম আমার সাথে আচরনের কথা। ১০/১২ দিন ভালো চলার পরেই দোকান বন্ধ হয়ে গেলো, কোথাও কাজ পাচ্ছি না। দেশে বিশাল খাদ্য অভাব চলছে। মা রেশন তুলার জন্য আমাকে মধুমিতা বিস্কুট ফ্যাক্টির সামনের দোকানে পাঠালো, বড় ভাই সফিউল্লাহকে মিতালী রোড মন্দিরের কাছের দোকানে। আমাদের রেশন কার্ড দুই ফাইল ছিল। কেরানী কেরামত, কয়াল সুনিল কিছুতে সামলাতে পারছেনা। আমাকে বললো সহায়তা করার জন্য। আমার কাছে কোনো কাজ না থাকায় লেগে পরলাম। এখানেও দশ-বারো দিন কাজের পরে কম টাকা ও কাজ অনেক বেশী প্ররিশ্রম হওয়া এবং তাদের নিজস্ব লোক এসে পরায় কাজটা ছেড়ে দিতে হলো। বাড়ী বসে গুলি খেলা, ঘুড়ি উড়ানোর জন্য বধ্যভুমি ঘুরে বেরানোই অভ্যাসে পরিনত হচ্ছিল। অভাব তিব্র থেকে তিব্র হচ্ছে,জ্বালানীর অভাব রান্নার জন্য লাকরী কিনে আনে হয় এডভোকেট মোহাম্মদ আলীর বাপ টোকানীর দোকান থেকে। মা বললো নিচে সারাদিন ঘুরে বেড়াও কত গরু চরায় মাইষে। একটা টুকরী লইয়া গেলেতো কিছু গোবর আনলেও কাজ হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের আগে ১৯৬৬,৬৭ সালে আমি, সামসু চাচা ও এলাকার অনেকেই পাঠশালা স্কুল ও আবাহনী মাঠের গোবর নিয়েই শিহ্মা ও পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ছিলাম। গোবর দিয়ে মুটঠী বানিয়ে নিজেদের চাহিদা ও পাল বাড়ীতে বিক্রি করতাম। চলবে ২৮ পর্ব নিয়ে। মহাসচিব বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি