জনাব রবিউল আলমঃ আজও কোন টাকা না দিয়েই চলে গেলেন সাংবাদিকরা,আমি কিছুটা আশা হত হলাম। আমি তখনো বুঝতে পারিনি এই দেশিও সাংবাদিকরা টাকা পাবে কোথায় পাবে, নামের জন্যই আমাকে বিনে পয়সায় কাজ করতে হবে, অনেকেই করে দেশ ও জাতির জন্য। আমার পেটের খুধার খবর কে রাখে। তবুও আশা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা,আপনজন হারা, আহত নিহতদের পরিবার খুজার জন্যই মনোনিবেশ করলাম। সকালে দোকানে এসেই জান্তে পারলাম, পাশের দোকানের একজন মাংস ব্যবসায়ী আজমল ভুইশা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আমি তাকে যুদ্ধের ৮ মাসই দেখিনি, তার বুড়ো বাবা মাঝে মাঝে দোকান খুলতো। মনে পরলো আলমের কথা, আলমের নাম সাইজুদ্দিন মাস্টার রাজাকারের লিষ্টে দিয়েছিল, হাসেম মাস্টারের মাধ্যমে।পাকিস্তানী হানাদার ও রাজাকার হাসেম চেয়ারম্যানকে অনেক জোরজুলুম করতো, দুই একদিন পরপর তার বাড়ীতে আসতে দেখতাম। টেনারী মোরের খুরশেদ কোম্পানি, মোহাম্মদপুরের চিনুমিয়া চেয়ারম্যান সহ অনেকেই বাঙালীকে রহ্মা করার নামে পাকিস্তানীদের সহায়তা করেছে। আলমকে রাজাকারা ধরে রাখতে পারেনি। কোনো এক রাতে অনেক অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে পালিয়ে গিয়েছিল। আলমের পালানোর পর থেকে বাঙালী রাজাকারদের উপর অত্যাচার নেমে আসলো, তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কেরে নেওয়া হলো, বিনিময় দেওয়া হলো লাঠি। দোকানের কাজ শেষ হতেই আলমের খোজে বের হয়ে গেলাম। রায়ের বাজারে পশ্চিম পাশে পাল সমিতির যায়গায় একটি ঘাট বাধানো পুশকুনি ছিলো, পুশকুনি পারে বিশাল আকৃতির তেতুল গাছ ও ধানের খেত ছিলো, এখন জাল জালিয়াত মাধ্যমে অনেক বড় বড় বিল্ডিং হয়েছে। পাশেই কাইউম মেম্বারদের একটা বাড়ী ছিলো। অনেক খুঁজাখুঁজির পরে সোনা মিয়ার ভাই আলমকে আবিস্কার করলাম। জান্তে চাইলাম রাজাকার আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প। আলমের মন ও শরিল দোটোই খারাপ থাকায় অন্য একসময় আসতে বললো। আমি তাকে সাংবাদিকদের কথা বললাম। তার কাছে, তার সাথে থাকা রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঠিকানা জান্তে চাইলাম। অনেক গুলো নামতো শুনালেন। ঠিকানা একজনের ও দিতে পারলেন না। আমি অযথা আর কথা বাড়ালামনা, এমনিতেই আলম কোকাচ্ছে। আমারও দোকানের কাজ শেষে খাওয়া হয় নাই। দুইবেলার ভাত একবেলাই খাওয়া হলো। ঘুমের পরে সকালে দোকানে, বেলা তিনটায় কাজ শেষ হলে, আজমলের বাবা ভুইয়া সাহেবের কাছে জানতে চাইলাম, আপনার ছেলে আসবে কবে। আজমলের সাথে আমারও পরিচয় আছে। ভুইয়া সাহেব অনেক মজার মানুষ ছিলেন। মজা করেই বললো, আবে পোলা কি আর আমার আছেরে। পোলাতো এখন জনগনের সম্পর্তি হয়ে গেছে। তুই দেখতা ছোঁছ না, আমি একা একা এই বুড়া বয়সে দোকান করি।বড় পোলায় নাকি নবাবপুরে দোকান লইছে মটরপার্সের। আমিও সব ফালাইয়া চইলা জামু। ভুইয়া সাবের দুঃখে খোচা দিছি মনে হয়,তার চোখের পানি টলমল করছে। আবেগে আর কথা কইতে পারছেনা, নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। কথা না বারিয়ে বাড়ী চলে গেলাম, খাওয়া দাওয়ার পরে কমিউনিটি সেন্টারের পাশের বাড়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত শিহ্মকের বাড়ীতে গেলাম, যে বাড়ী থেকে ভয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। আমাকে দেখেই বসতে বললো, অনেক কষ্টে আছে বলে জানালেন। বাচ্চা দুইটাই ছোট, স্কুল এখনো খুলে নাই। নিজেই বাজার সদাই করতে হয়। ঘরে টাকা পয়সাও তেমন রেখে যায় নাই। আত্নীয় সজনের কাছ থেকে কত আর হাত পেতে নেবো। আমার ভাই এরা কিছু টাকা দিয়েছিল, তাই দিয়ে চলছি। আরো কিছুদিন চলতে পারবো। তারপরে কি হবে বুঝতে পারছিনা রবিউল। তোমার স্যারের অফিস থেকে একজনও খবর নিচ্ছে না। তিন মাসের বেতনও পাওনা আছে, কার কাছে কিভাবে খবর নিবো তাও জানিনা।এই অমানুষিক জীবন আর চলতে চায় না। রবিউল পারলে আমাকে একটু সহায়তা করো, টাকা পয়সা নয়। তোমার স্যারের অফিসে যোগাযোগ করিয়ে দাও, আমি তার দিকে অপলক হয়ে চেয়ে আছি, নিজের অবস্তাটা বিবেচনা করছি। শান্তনা দেওয়ার ভাষা নাই আমার কাছে। বেগম সাহেব বলেই চলেছেন নিজের অজান্তেই, কার কাছে বলছেন, কি তার হ্মমতা ও যোগ্যতা বিবেচনা না করেই বলে চলেছেন। আমিও তাকে থামালাম না, দুঃখের কথা বলে যদি মনটা একটু হালকা হয়। চলবে ২৩ পর্বে।
লেখকঃ বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব ও রাজধানী মোহাম্মদপুর থানার ৩৪ নং ওয়ার্ড আওয়ামলী লীগের সভাপতি জনাব রবিউল আলম।